আরাফাত মুন্না ॥ গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ঝকঝকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ঢাকায় চলাচলকারী দূরের যাত্রীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। যাত্রাবাড়ীর অতিচেনা পুরনো যানজটেরও অবসান হয়েছে। তবে নিচের রাস্তায় যাতায়াতকারী মানুষদের কি দুর্ভোগ কমেছে? মোটেও না, বরং বেড়েছে। এই ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তার যেমন দুরবস্থা, তার চেয়ে বড় সমস্যা অবৈধ বাস ট্রাক স্ট্যান্ড। ফ্লাইওভারের নিচের খালি রাস্তা ও ফাঁকা জায়গাজুড়ে লাইন দিয়ে রাখা হচ্ছে বাস, মিনিবাস, ট্রাক। কোন কোন জায়গায় এমনভাবে গাড়িগুলো রাখা থাকে, তাদের দয়া না হলে সাধারণ যাত্রীবাহী পরিবহন চলতেই পারে না। রাজধানীর অন্যান্য ফ্লাইওভারগুলোর চিত্রও ভিন্ন নয়।
যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা লোকমান আলী। তিনি টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটের একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে টিকাটুলি সামান্য এই রাস্তা যেতে ঘণ্টা খানেক সময়ও লেগে যায়। অথচ রাস্তা যদি ফাঁকা থাকে তাহলে কয়েক মিনিটেই যাওয়া যায়। এত সময় কেন লাগে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাস্তার প্রায় পুরোটাই ট্রাক ও বাসস্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে, গাড়ি চলবে কোন জায়গা দিয়ে? পাল্টা প্রশ্ন করেন লোকমান।
সরেজমিন দেখা যায়, সায়েদাবাদ সিএনজি স্টেশনের পাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তাসহ প্রতিটি সংযোগ রোডে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাস ডিপো ও স্ট্যান্ড। রাস্তাজুড়ে রাখা হচ্ছে বাস-ট্রাক-টেম্পো। যাত্রাবাড়ী-দোলাইপাড়, যাত্রাবাড়ী-শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ী-ডেমরা, যাত্রাবাড়ী-ধোলাইখাল সড়কজুড়ে একই অবস্থা। যাত্রাবাড়ী-দোলাইপাড় সড়কের এক পাশে মাওয়াসহ বিভিন্ন পরিবহনের গাড়ির অবৈধ পার্কিং ও বাসস্ট্যান্ড। আরেক পাশে টেম্পো, লেগুনা, মিরপুর রুটের ১৫ নম্বর গাড়ির ট্রান্সসিলভা, শিকড়-শিখর ও তুরাগের স্ট্যান্ড। মাওয়া রুটের ও টঙ্গী রুটের পরিবহনের বাস ও মিনিবাসগুলো এখানে অঘোষিতভাবে স্থায়ী ডিপো ও বাসস্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে। এতে যেমন যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি এ পথে চলাচলকারীদের নিত্য হয়রানি ও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো হেনস্থা হতে হচ্ছে চালক ও শ্রমিকদের হাতে।
কিছুদিন আগে ফ্লাইওভারের নিচে সায়েদাবাদে গড়ে ওঠা অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড প্রশাসন উচ্ছেদ করলেও আবার যথারীতি তা চলে গেছে ট্রাক শ্রমিকদের দখলে। সায়েদাবাদের জনপথ মোড়ে যেখানে একটি ত্রিভুজ সড়কদ্বীপ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এখন চলছে স্থায়ীভাবে বাস রাখার জন্য ঢালাই দিয়ে পাকা জায়গা নির্মাণের কাজ। এ বিষয়ে জানা যায়, ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন, বাস মালিক-শ্রমিকসহ স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায়ই এসব হচ্ছে। প্রতিদিন গাড়ি রাখার জন্য দিতে হয় ভাড়া ও চাঁদার টাকা।
এ বিষয়ে চালক ও শ্রমিকদের সহজ উত্তর, গাড়ি এখানেই থাকবে, এখান থেকে যাবে কই? আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের নিয়ন্ত্রণে যেটুকু সেটা আমরা দেখভাল করছি। তবে সড়কের ওপর নিয়ন্ত্রণ সড়ক ও জনপথ বিভাগের। সওজ বলছে, আমাদের কাজ রাস্তা নির্মাণ ও সংরক্ষণ। এসব দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর। তারা উচ্ছেদে আগ্রহী নয়। কারণ, নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি।
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী থানার পাশে ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে ট্রাক ও পিকআপস্ট্যান্ড। সেখানে প্রায় ১০০ ট্রাক ও পিকআপ থাকে রাস্তা দখল করে। প্রতি গাড়ি স্ট্যান্ডে রাখার জন্য প্রতি মাসে ১২০০ থেকে ১ হাজার টাকা চাঁদা নেয়া হয়। এছাড়া মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামে চাঁদা নেয়া হয় ৮০ টাকা। স্ট্যান্ডের পাশেই মাছের আড়ত। মাছের আড়তে মানুষের ভিড় আর রাস্তার ওপর সারিবদ্ধ ট্রাক, সবমিলিয়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট। স্ট্যান্ডটি নিয়ন্ত্রণ করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন খান ও স্থানীয় শ্রমিক লীগের নেতারা। জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, মাছের আড়তে মাছ নামানোর পর ট্রাক ও মিনি ট্রাকগুলো ফাঁকা জায়গায় রাখা হয়। রাস্তার ওপর গাড়ি রাখলেই সেগুলো সরিয়ে দেয়ার জন্য আলাদা লোকজন আছে। তারা যানজট নিরসনে কাজ করছে।
ফুলবাড়িয়া থেকে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে বঙ্গবাজারে যাওয়ার সড়কটি পরিণত হয়েছে মহানগর ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলাচলকারী বাসের ‘গ্যারেজে’। সেখানে গাড়ি রেখে কলকব্জা খুলে মেরামত চলে। চালক ও তাদের সহকারীরা বাস থামিয়ে বিশ্রাম নেন। বৃহস্পতিবার ওই সড়কে ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-ধামরাই রুটের ঢাকা পরিবহন, শুভযাত্রা পরিবহন, গ্রামীণ সেবা, গাজীপুর রুটের গাজীপুর পরিবহন, গুলিস্তান আব্দুল্লাহপুর (১৩২), প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন, গোপালগঞ্জ রুটের মধুমতি পরিবহন, ইমাদ পরিবহনের অর্ধশতাধিক বাস সড়ক আটকে দাঁড়িয়ে। এর অনেকগুলোতে চলছে মেরামতের কাজ।
রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচেও গড়ে উঠেছে বাস-ট্রাক-মিনি ট্রাক প্রাইভেটকারের অঘোষিত টার্মিনাল। সরকারী জমি, ব্যস্ত রাস্তা জুড়ে নির্মিত হয়েছে অবৈধ দোকানপাট, টিনের ঘরসহ নানা স্থাপনা। ফ্লাইওভারটি নির্মাণ শেষে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের মানুষ বিকেলে দল বেঁধে কুড়িল এলাকায় আসতেন ঘুরে বেড়াতে। সন্ধ্যার পর থেকেই ফ্লাইওভার জুড়ে বৈদ্যুতিক আলোতে চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হতো। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন ফ্লাইওভার অতিক্রমকালে দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পেতে গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকে না। অন্যরা নাকে-মুখে রুমাল চেপে অতিকষ্টে জায়গাটি পার হন। এখানে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সন্ধ্যা হতেই বখাটে, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্যে কুড়িল ভীতিকর এলাকায় পরিণত হয়। শুধু ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধই নয় নানা সমস্যায় বেহাল কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকা। পর্যাপ্ত আলো না থাকায় নানা অপকর্ম সংঘটিত হয়।
এদিকে ফ্লাইওভারের নিচে ব্যস্ততম রাস্তাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে মিনিবাসের টার্মিনাল। রাস্তার উপরেই চলে গাড়ি ধোঁয়া মোছা ও মেরামতের কাজ। পূর্বপাশের গোটা রাস্তা দখল করেই গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ প্রাইভেটকার টার্মিনাল। বৈধ কাগজপত্রহীন, ফিটনেস ও রুট পারমিটবিহীন দেড় শতাধিক প্রাইভেটকারের মাধ্যমে নানাভাবে চলছে যাত্রী হয়রানি। ফ্লাইওভারের নিচে অবৈধ স্ট্যান্ড ও টার্মিনালকে ঘিরে ছোট-বড় ২০ গ্যারেজ-ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ডা. জিন্নাত আলী বলেন, একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তবে উচ্ছেদের খবর পেলেই এই এলাকা খালি হয়ে যায়। অভিযান শেষ হলেই ফের দখল হয়ে যায়। এটা নিয়ে বেশ বিপাকে আছি।
সরেজমিন পোস্তগোলা ট্রাকস্ট্যান্ডে গিয়ে জানা যায়, পোস্তগোলা ব্রিজের নিচে সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে অবৈধভাবে ট্রাক এবং পিকআপস্ট্যান্ড করা হয়েছে অনেক বছর আগে। ট্রাকস্ট্যান্ড ঘিরে মাদক ব্যবসাও জমজমাট সেখানে। ট্রাক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই স্ট্যান্ড দিয়ে বাস-ট্রাক ঘোরানোর জন্যও দিতে হয় গাড়ি প্রতি ২০ টাকা। এছাড়া সেখানে গাড়ি পার্কিং করতে প্রতিদিন গাড়ি প্রতি চাঁদা দিতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা।