১৪ অক্টোবর বিশ্ব ডিম দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সুস্থ যদি থাকতে চান, প্রতিদিন ডিম খান’। ভিয়েনায় ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ সম্মেলনে জনসাধারণকে ডিম খাওয়ার ব্যাপারে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় বিশেষ করে নাস্তার সময় সবাই ডিম খেতে পছন্দ করেন। সময় স্বল্পতার জন্য ভাতের সাথে তরকারির বিকল্প হিসেবে ডিম ভাজি বা ভর্তা করেও অনেককে খেতে হয়। প্রশ্নটা হলো প্রতিদিন বা নিয়মিত ডিম খাওয়া যাবে কি যাবে না, এ নিয়ে ডাক্তার, রোগী এমনকি সুস্থ মানুষের মাঝেও বিভ্রান্তি বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল এবং এখনও আছে। বিশেষ করে যাদের বয়স একটু বেশি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগী অথবা যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বা অন্যান্য চর্বির পরিমাণ বেশি, তাদের ডিম খেতে নিষেধ বা সম্পূর্ণ বর্জন করতে বলা হয়। অনেকেই আবার ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে শুধু সাদা অংশটুকুই খেতে বলেন। এর কারণ একটাই, তা হলো ডিম খেলে কোলেস্টেরল বাড়ে, তাতে উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। এতদিনের এই ধারণাটা আসলে সত্যি নয়। ডিম খেলে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা ততটা বৃদ্ধি পায় না। একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষ দৈনিক গড়ে ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত কোলেস্টেরল গ্রহণ করতে পারেন। আর একটি ডিমে রয়েছে মাত্র ২০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল।
তাই বিশেষজ্ঞগণ এমনকি আমেরিকান হার্ট এ্যাসোসিয়েশন এখন আর তাদের খাদ্যের গাইড লাইনে ডিম খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করছেন না। যে কোন ব্যক্তি ডিমের সাদা অংশ খেলে কোন সমস্যাতো হবেই না, এমনকি কুসুমসহ সম্পূর্ণ ডিম খেলেও উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে না। একটি বড় গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, প্রতি সপ্তাহে ৫-৬টি ডিম আহারে হৃদরোগ, স্ট্রোক বা অন্যান্য ধরনের হৃদরোগের কোন ঝুঁকি নেই। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে বলা হয়, দিনে ১টি ডিম হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়। সকালের নাস্তায় একটি ডিম কোলেস্টেরল প্রোফাইলের ওপর তেমন কোন প্রভাব ফলে না, যতটা প্রভাব ফেলে আপনার সকালের নাস্তায় মিষ্টি বা চর্বি জাতীয় খাবারে।
ডিমে আছে ভিটামিন এ, ই, বি ৬, বি ১২, ফলেট, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম, এ্যামাইনো এ্যাসিড ইত্যাদি। ডিম খেলে এগুলো সহজলভ্য এবং দামে সাশ্রয়ী। ডিমের মধ্যে যে প্রোটিন, ভিটামিন বি ১২, রাইবোফ্লোবিন, ফলেট ও ভিটামিন ডি রয়েছে, তা কোলেস্টেরল বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দয়। এমনকি অনেকদিন সংরক্ষিত বা প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়ার চেয়ে ডিম ভাল বিকল্প খাদ্য হতে পারে।
অনেকে হাঁস বা মুরগির ডিম এমনকি সাদা বা লালচে ডিম খাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেন, আসলে সব ধরনের ডিমের পুষ্টিগুণ একই রকম। কেউ কেউ আবার কাঁচা ডিম খেতে পছন্দ করেন, এমনকি কাঁচা ডিমের পুষ্টিগুণ বেশি বলে মনে করেন, এ ধারণাটাও সত্যি নয়। বরং কাঁচা ডিম খেলে সালমোনেলা জাতীয় ব্যাক্টেরিয়ায় আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে।
তরুণরা এবং যারা বেশি কায়িক পরিশ্রম করেন, তারা নিয়মিত ডিম খেতে পারেন। এমনকি বয়স্করা সপ্তাহে কয়েকটি ডিম খেতে পারবেন। আর যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত ডিম খাওয়া উচিত। তবে কিডনি অকেজো বা রেনাল ফেইলুরের রোগী ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডিম খাবেন, কারণ কিডনি ফেইলুরে প্রোটিন কম খাওয়া উচিত। কারও কারও বেলায় ডিম খেলে এ্যালার্জি জাতীয় সমস্যা হতে পারে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
উপসংহারে বলা যায় :
১. ডিম অবশ্যই একটি প্রাকৃতিক পুষ্টিকর খাদ্য যার মধ্যে খাদ্যের সকল উপাদানই বিদ্যমান। সব বয়সের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডিম অত্যন্ত কার্যকর। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, মানসিক দক্ষতা এবং মহিলাদের শারীরিক চাহিদা পূরণে ডিম অত্যন্ত জরুরী।
২. ডিমে উচ্চ কোলেস্টেরল আছে বটে, কিন্তু তা রক্তের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে না। বরং রক্তের ভাল কোলেস্টেরল (ঐউখ) বৃদ্ধি করে। সাথে সাথে ট্রাইগি সোরাইডও কমায়।
৩. ডিমে এন্টিঅক্সিডেন্ট যথেষ্ট পরিমাণে থাকে, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতায় সহায়ক, অন্ধত্ব দূরীকরণেও সহায়ক।
৪. নিয়মিত ডিম খেলে হৃদরোগ বৃদ্ধি পায় না, বরং ব্রেনের স্ট্রোক কমাতে সহায়তা করে।
৫. টাইপ ২ ডায়াবেটিস ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে ডিম কিছুটা হলেও কার্যকর।
অতএব সুস্বাস্থ্য এবং খাদ্যের জরুরী উপাদান প্রোটিন গ্রহণের জন্য নিয়মিত ডিম খাওয়া নিয়ে কোন বিতর্ক বা বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
লেখক : অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ ডিন,
মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা