ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৮ মে ২০১৬

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

(গতকালের পর) পরদিন ভোরে খুব ক্লান্ত এসপি মারুফুল হক এলেন ডিসি জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে। মারুফুল গতকালের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। ফটিকছড়ির এক গ্রামে মনজুর সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন এ খবর পাওয়ার পর ইন্সপেক্টর কুদ্দুস তার বাহিনী নিয়ে রওনা হন। কুদ্দুস জানিয়েছেন, মনজুর যে জিপটি চালাচ্ছিলেন সেটি গ্রামে ঢোকার মুখে পার্ক করা ছিল। পুলিশ যখন গ্রামের ওই কুঁড়েতে ঢোকে তখন তিনি নাশতা করছিলেন। পুলিশ দেখে তিনি পালাবার বা প্রতিরোধের কোন চেষ্টা করেননি। শুধু বললেন, তিনি চান তাকে যেন বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে থানাতে রাখা হয়। ভীত পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে তিনি ওঠেন পুলিশভ্যানে। হাটহাজারী থানায় তাকে নিয়ে লকআপে রাখা হয়। মনজুরকে থানায় রাখা হয়েছে এই খবর পেয়ে দলে দলে লোক থানায় আসতে থাকেন। এই ব্যাপারটি থানার পুলিশদের বিচলিত করে তোলে। তখনই তারা চেয়েছেন মনজুরকে থানা থেকে সরিয়ে নেয়া হোক। পরবর্তী ঘটনা জানা। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পেয়ে মনজুরকে হস্তান্তর করা হয়। ক্যাপ্টেন পুলিশের কাগজপত্রে সই করে দেন। লকআপ থেকে মনজুর, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে বাইরে আনা হয়। মনজুর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন তিনি এখন আর সেনাবাহিনীতে নেই, আছেন পুলিশ হেফাজতে। পুলিশ তাকে থানা প্রাঙ্গণ থেকে আর্মি ভ্যানের কাছে নিয়ে যায়। আর্মি ক্যাপ্টেন কারাতে স্টাইলে মনজুরকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন ও দুজন সৈন্যের সাহায্যে তার দুহাত বেঁধে ফেলেন। মনজুরের স্ত্রী ও সন্তানরা তখন চিৎকার করে কাঁদছিলেন। মনজুর ছিলেন নিরস্ত্র, বন্দিত্বেরও প্রতিবাদ করেননি। তা সত্ত্বেও সেই ক্যাপ্টেন এমন আচরণ করেছিলেন। তাকে সাধারণ কয়েদির মতো পিকআপের পিছে ফেলে দেয়া হয়। সশস্ত্ররা তাকে ঘিরে থাকে। ভ্যানের সামনে মনজুরের স্ত্রী ও সন্তানকে বসিয়ে ক্যাপ্টেন ভ্যান নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওনা দেন। পুলিশ বা বেসামরিক কর্তৃপক্ষ ভাবছিলেন, মনজুরকে ক্যান্টনমেন্টে নেয়া হচ্ছে বোধহয় ইন্টারগেশনের জন্য। কিন্তু সেনা কর্তৃপক্ষের মতলব যে অন্য তা তারা অনুধাবন করেননি। পরের দিন সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনার জন্য কমিশনার, ডিসি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ডিআইজি কমিশনারের কার্যালয়ে বসেছেন। এমন সময় ডিআইজির কাছে ফোন। ফোনালাপ সেরে তিনি জানালেন চট্টগ্রাম গ্যারিসনের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আজিজ জানিয়েছেন মনজুর মৃত। পুলিশ যেন তার মৃতদেহ ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিয়ে যায়। ডিআইজি শাহজাহান জানালেন এ বিষয়ে তাকে কমিশনার ও ডিসির সঙ্গে আলাপ করতে হবে। এ খবর শুনে সবাই বিমূঢ়। শর্টকাটে আর্মি কাজ সেরেছে। এখন আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব বেসামরিক কর্তৃপক্ষের। জিয়াউদ্দিন জানালেন এ কাজে তারা যুক্ত হবেন না। তার ভাষায়- ‘obviously, the army had made short work of Manzoor, and wanted to leave us, the civil administration, dispose of their dirty work.Õডিআইজিকে তারা পরামর্শ দিলেন, ব্রিগেডিয়ার আজিজকে জানাতে যে, আইন অনুযায়ী পুলিশকে মৃতদেহ হস্তান্তর করলে পুলিশ ময়নাতদন্ত করবে এবং এই মৃত্যু চিহ্নিত হবে ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে। যদি ব্রিগেডিয়ার চান পুলিশে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে তাহলে তাকে আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। ব্রিগেডিয়ার আজিজ ময়নাতদন্তে রাজি নন। তিনি জানালেন, করণীয় তিনি জানাবেন। কয়েক মিনিট পর তিনি জানালেন, সেনাবাহিনী বিষয়টির সুরাহা করবে, পুলিশের দরকার হবে না। পরদিন ঢাকা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজে সরকারী প্রেস নোটের বরাত দিয়ে জানানো হলো, মনজুরকে যখন ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা হয় তখন ক্রুদ্ধ সৈন্যরা তাকে আক্রমণ করে। সংঘর্ষে তিনি নিহত হন। জিয়াউদ্দিন বলছেন, এটি একটি গল্প [The report was downright fiction.] ক্যান্টনমেন্টে নেয়ার পথে মনজুর নিহত হয়নি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ যা জানিয়ে ছিলেন তাই ঠিক। ২ জুন, ১৯৮১ সালে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তাকে হত্যা করা হয়। ব্রিগেডিয়ার আজিজ বলেননি, ক্রুদ্ধ সৈন্যদের হাতে মনজুর নিহত হয়েছেন। কীভাবে তিনি মারা গেছেন তাও বলেননি। মনজুরের মৃত্যুর ব্যাপারটা কয়েকদিন পর সেনাবাহিনীর সেই ডাক্তার জিয়াউদ্দিনকে জানিয়েছিলেন যিনি কয়েকদিন আগে জিয়ার মরদেহ পরিষ্কার করেছিলেন। মনজুরের মৃতদেহ কবরে নামানোর আগে তার ক্ষত ব্যান্ডেজ করা হয়েছিল। তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে ডাক্তার অবশ্য তা বলেননি। ক্যান্টনমেন্টের সেলে মনজুরকে রাখা হলে একজন ব্রিগেডিয়ার সেই সেলে প্রবেশ করেন [ডাক্তার তার নাম জানাননি] ‘তার উদ্দেশ্য ছিল একটি। মনজুরকে হত্যা করা। তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন এবং প্রহরারত সেনা কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন মনজুরকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। ভেতরে ঢুকে মনজুরকে গুলি করে তিনি বেরিয়ে যান যেন’ পূর্বপরিকল্পনা মতো। [He went in, fired his pistol at Manzoor, and walked out— all according to some agreed plan.] ডাক্তারকে যখন ক্ষত ব্যান্ডেজ করতে বলা হয় তখন দেখেন একটি বুলেট তার মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে, একঝাঁক বুলেট নয়। মনজুর হত্যার পর চট্টগ্রাম গ্যারিসনের ৫০ জন সেনা অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়। মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত ফিল্ড কোর্ট মার্শালে তাদের বিচার হয়। ৩৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, জিয়ার ব্যক্তিগত সচিব লে. কর্নেল মাহফুজসহ। দুই সপ্তাহে বিচার শেষ। ফাঁসির আদেশ হয়েছিল ১৩ জনের [অধিকাংশ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা] ফিল্ড কোর্ট মার্শাল গঠনের পর ডিসিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় চট্টগ্রাম জেলা সেলে বিচারের ব্যবস্থা করতে। আসামিদের সেখানে রাখা হয়েছিল। অনুরোধটি ছিল অস্বাভাবিক। কারণ, বিচার হওয়ার কথা ক্যান্টনমেন্টে। যা হোক বিচার হলো। জিয়াউদ্দিন ভেবেছিলেন তাকেও হয়ত সাক্ষী মানা হবে। পরে আবদুর রহমান তাকে জানিয়ে ছিলেন তার সাক্ষ্যের কোন গুরুত্ব নেই দেখে ডাকা হয়নি। বিচারের আগে মেজর জেনারেল মোজাম্মেল ও বিচারপতি এটিএম আফজালের নেতৃত্বে সামরিক ও বেসামরিক দুটি তদন্তকমিটি করা হয়েছিল। কোন কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। সরকারের ভাষ্যই বিচারে প্রতিফলিত হয়েছিল। জিয়া হত্যার জন্য মনজুরকেই দোষী করা হয়েছিল। জিয়াউদ্দিন উপসংহারে যা বলেছেন, প্রচলিত সাধারণ মতামতও তাই। মনজুর ও জিয়া ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ১৯৭৫-এর পর মনজুর জিয়ার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট কাজ করেছেন। নোয়াখালীর ডিসি থাকার সময়ের একটি ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি তখন চিফ অব জেনারেল স্টাফ। তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন, জিয়া সরকারের পেছনে সবাইকে থাকতে হবে। কেননা জিয়া ‘সার্বভৌমত্বের’ প্রতীক। জিয়ার মতো তিনিও মনে করতেন, সরকার পরিচালনায় সেনাদের ভূমিকা থাকতে হবে। জিয়া রাজনৈতিক দল করার পর বিশেষ করে স্বাধীনতা বিরোধীদের দলে নেয়ার পর তার সঙ্গে জিয়ার দূরত্বের সৃষ্টি হয়। মনজুরকে সরিয়েও দেয়া হয়। কিন্তু জিয়ার ওপর তার এমন কোন আক্রোশ ছিল না যে কারণে জিয়াকে হত্যার কথা তিনি ভেবেছিলেন। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, জিয়া এলে তিনি তাকে অভ্যর্থনা জানাতে যেতেন বিমানবন্দরে কিন্তু প্লেন মাটি না ছোঁয়া পর্যন্ত গাড়িতে বসে থাকতেন। জিয়ার দলের নেতাদের তিনি পছন্দ করতেন না। জিয়া নেমে এলে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে যেতেন। জিয়ার রাজনৈতিক সহকর্মীদের তিনি অপছন্দ করতেন কিন্তু জিয়াকে নয়। অন্য সময় দুজনে পুরনো বন্ধুর মতোই আচরণ করতেন। জিয়াউদ্দিন সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করে মনে করেন, ষড়যন্ত্রটি হয়েছিল চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকায়। জিয়া হত্যার পর বিদ্রোহীদের দায় তার ওপর পরে যা তিনি নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না কিন্তু নিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রটা কোথায় তা তিনি জানতে পেরেছিলেন সে জন্য ঢাকা থেকে এক ব্রিগেডিয়ারকে পাঠিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। মনজুরকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন ‘a coup leader by default.’ জিয়া হত্যার সঙ্গে আসলেই তার কোন যুক্ততা ছিল না। ॥ আট ॥ যেসব সেনা কর্মকর্তা আত্মজীবনী লিখেছেন, তাদের তিনজনের লেখায় জিয়া হত্যার ঘটনাটি এসেছে। এদের একজন হলেন লে. কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জিয়ার খানিকটা সিনিয়র হলেও বন্ধুর মতো ছিলেন। জিয়া তাকে ডেকে মন্ত্রী করেছিলেন। তার বইয়ের নাম রণ থেকে জন। ১৯৯৫ সালে স্টুডেন্ট ওয়েজ বইটি বের করে। তার বইয়ে স্বাভাবিকভাবে জিয়ার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে এবং জিয়ার মৃত্যুর ঘটনা অতিসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে যদিও তিনি ছিলেন তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সামরিক আইন প্রত্যাহার বিষয়ক ফরমানে সই করার পর কর্নেল রাষ্ট্রপতি জিয়ার কলমটি চেয়ে নেন। কারণ ঘোষণাটি ঐতিহাসিক। তার মতে, সামরিক আইন ঘোষণা করেছিলেন মোশতাক, জিয়া তা প্রত্যাহার করেছিলেন। প্রত্যেক বিএনপি কর্মী যা বলে কর্নেল তাই পুনরাবৃত্তি করেছেন। ‘কিন্তু জিয়াউর রহমান দেশের সব থেকে ভাগ্যবান এবং একই সঙ্গে গর্বিত রাষ্ট্রপতি, কেননা তিনিই এই সামরিক আইন প্রত্যাহার করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথকে কণ্টকমুক্ত করেন। এর আগে ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি একদলীয় ‘বাকশাল’ শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ ভাগ্যবান। জিয়ার মতো একজন লোক এই সময় দেশের হাল ধরেছিলেন। ’ [পৃ. ৬০] আগেই উল্লেখ করেছি, বিএনপির সব নীতিনির্ধারকই এই বক্তব্য রাখেন। কারণ একটিই, জিয়া যে সামরিক শাসক ছিলেন না, পাকিস্তানী ধারা তিনি অনুসরণ করেননি তা প্রমাণের জন্য। কিন্তু এটি বিভ্রান্তিকর, সত্য নয়। জেনারেল মনজুরকে সেনাপ্রধান না করে এরশাদকে সেনাপ্রধান করা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে তিনি মনে করেন। তিনি লিখেছেন, মনজুরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কারণ তিনি বেঁচে থাকলে প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারী কে তা উদ্ঘাটিত হয়ে যেত। তিনি ইঙ্গিত করেছেন এরশাদ হয়ত জড়িত ছিল। তার মতে, ‘জেনারেল মনজুরকে গ্রেফতার করেছিলেন যে ওসি তার নাম ছিল সম্ভবত কুদ্দুস। এরশাদের আমলে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন। তার প্রতি এরশাদের বহু পৃষ্ঠপোষকতা, দেশে নানা কথা ও সন্দেহের জন্ম দেয়।’ [পৃ. ৭৬] সাধারণ মতামতও তা, কিন্তু আরও আশ্চর্য যে বেগম জিয়া এক দশক ক্ষমতায় ছিলেন কিন্তু কখনও জিয়া হত্যার তদন্ত করেননি। এরশাদ যে তদন্ত করিয়েছিলেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। এরপর তিনি এরশাদের ক্ষমতা দখল ও শাসনকাল নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী সিএমএইচে এরশাদ ও এআরএস দোহা ক্ষমতা দখলের মূল ষড়যন্ত্র করেন এবং জিয়া যাদের বিশ্বাস করে কাছে টেনেছিলেন তারাই এরশাদের পক্ষ হয়ে কাজ করেন। লিখেছেন তিনি, ‘জেনারেল মজিদ উল হক (সংস্থাপনমন্ত্রী) এরশাদকে বরখাস্ত করার একটি কাগজ প্রায় তৈরি করে ফেললেন। কিন্তু মিলিটারি সেক্রেটারি ও জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরী এরশাদকে তা জানিয়ে দেন। এরশাদ যখন উপলব্ধি করল আমি কখনই তার সহায়ক শক্তি হব না তখন আমাকে তিনি চাপ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ থেকে সরিয়ে দিলেন।’ [পৃ. ৮২] (চলবে)
×