স্টাফ রিপোর্টার ॥ ক্রমশই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশ। নানামুখী উন্নয়ন সূচকেও রয়েছে উর্ধগামিতা। তবে এত উন্নয়নের মাঝেও চোখে পড়ে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার চিত্র। মানবিকতা ও কল্যাণবোধের অভাবে হিংসা-বিদ্বেষ এবং নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন পরিণত হয়েছে প্রতিদিনের ঘটনায়। এমন সময়ের আনন্দের বারতা নিয়ে বছর ঘুরে আবার আসছে বাঙালীর প্রাণের উৎসব নববর্ষ। জাতিসত্তার অনিন্দ্য প্রকাশের দিনটির সূচনা হবে রমনা বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী সঙ্গীতায়োজনে। অশুভ তৎপরতা রুখে দেয়ার প্রত্যয়ে ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি এবার নববর্ষ উদ্্যাপন করবে মানবতার আহ্বানে। মানবতার মর্মবাণী ধারণ করে স্বাগত জানাবে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে।
মানবতাকে বিষয় ধরে পয়লা বৈশাখ সকাল সোয়া ছয়টায় রমনা বটমূলে শুরু হবে ছায়ানটের প্রভাতী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। অংশ নেবেন প্রায় দেড়শ শিল্পী। দুই ঘণ্টা বেশি ব্যাপ্তির অনুষ্ঠানটি শেষ হবে সকাল সাড়ে আটটায়। ১৫টি একক গান, ১২টি সম্মেলক গান, ৩টি আবৃত্তি ও পাঠ দিয়ে সাজানো হয়েছে অনুষ্ঠান। সন্্জীদা খাতুনের শুভেচ্ছা কথনের মাধ্যমে শেষ হবে অনুষ্ঠান। দ্বৈত কণ্ঠে সকালের রাগ আলাপ দিয়ে শুরু হবে পরিবেশনা। ১৩ এপ্রিল বিকেল ৪টায় রমনা বটমূলে হবে নববর্ষ অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত মহড়া। এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার।
বর্ষবরণের আয়োজনে চলমান বাস্তবতা তুলে ধরে ছায়ানট সভাপতি ড. সন্জীদা খাতুন বলেছেন, পাকিস্তান আমলেও আমরা নববর্ষ উদ্্যাপন করতে ভয় পাইনি। কারণ তৎকালীন সরকারও বুঝে উঠতে পারেনি আমরা নিরীহ মানুষগুলো কেন পয়লা বৈশাখে গান গাই। যখন বুঝতে পেরেছে, তখন বাধা এসেছে। কিন্তু তখন আমরা ভয় পাইনি অথচ এখন নববর্ষ উদ্্যাপনে ভয়ের কারণ ঘটছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ছায়ানটের নববর্ষ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। আমরা বিরোধিতার মুখোমুখি হচ্ছি। গোপন প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হয়েছি। তাই যুদ্ধ করার সময় এখনও কাটেনি। আমরা গানে গানে হানাহানি বন্ধ করে মানবতার কথা বলব। সুরের পথ ধরেই মানবতার বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে চালিয়ে যাব আমাদের যুদ্ধ। পহেলা বৈশাখে পুলিশের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশ পহেলা বৈশাখে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা করছে। সে কারণে বিধি-নিষেধ দিচ্ছে। আমরা এটার পক্ষে। বর্তমান সরকার সংস্কৃতির সপক্ষ শক্তি। এ কারণে আমি মনে করি না, সরকারীভাবে পহেলা বৈশাখের আয়োজনকে নিয়ন্ত্রণ বা সংকুচিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সোমবার বিকেলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি জানান, ছায়ানটের বর্ষবরণের এবারের বিষয় মানবতা। গান ও কবিতায় মানবতার মর্মবাণী দর্শক-শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরবেন শিল্পীরা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ছায়ানটের সহ সভাপতি ডাঃ সারওয়ার আলী ও সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল।
ডাঃ সারওয়ার আলী বলেন, পাকিস্তানী শাসকরা বাঙালিত্বের যে সংস্কৃতি তা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সেই পরিস্থিতির মোকাবেলায় আমরা আন্দোলন করেছি, মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু এখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও সর্বগ্রাসী লোভের বশবর্তী হয়ে, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে কিছু মানুষ মনুষত্বকে অবমাননা করছে। তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মানবতার শক্তি প্রতিটি হৃদয়ে যাতে জাগ্রত থাকে তার জন্য সকল সংস্কৃতিকর্মীকে কাজ করতে হবে। আর মানবিক সমাজ গড়তেই এবারের আয়োজনটি সাজানো হয়েছে মানবতার গানে গানে। লিখিত বক্তব্যে খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, এবারের নববর্ষ আসছে প্রকৃত অর্থে বাঙালী জাতির নতুন করে জেগে ওঠার তাগিদ নিয়ে। বটমূলের আয়োজনের এবার ৪৯ বছর। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান আমলে প্রতিকূল পরিবেশে বাঙালীর আপন সত্তা জাগিয়ে তোলা এবং আপন সংস্কৃতিতে বাঁচবার বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার মানসে বাংলা বছরকে আবাহন জানাবার উদ্যোগ নেয় ছায়ানট। গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে দেশপ্রেমে সমৃদ্ধ পূর্ণাঙ্গ বাঙালী হয়ে ওঠার, পুরাতনের আবর্জনা দূর করে নতুন সৃজনের প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হওয়ার, মানুষকে ভালবেসে সবার সঙ্গে মিলে নবযাত্রায় শামিল হওয়ার প্রেরণাসঞ্চারী প্রভাতী সঙ্গীতায়োজন করে আসছে মানুষের ভালবাসাধন্য এই সংগঠন। প্রাণিত করেছে আপামর বাঙালীকে। দিনে দিনে বাংলা নবর্বষের অনুষ্ঠান প্রসারিত হয়েছে সারাদেশে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন আজ বাঙালীর সবচেয়ে বড় মিলনমেলা, রূপান্তরিত হয়েছে জাতীয় উৎসবে।
বেঙ্গল বৈশাখ উৎসবের তৃতীয় দিন ॥ ‘চিত্ত জাগুক গানে গীতে কাব্যে কথায়’Ñ এ প্রতিপাদ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন নববর্ষ আবাহনে আয়োজন করেছে পাঁচদিনব্যাপী বৈশাখ উৎসব। এ উৎসবের তৃতীয় দিন ছিল সোমবার। এদিনের আয়োজনে ছিল তিন গীতিকবি অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানসহ রাগাশ্রয়ী গান। সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। পাঁচদিনের এই অনুষ্ঠানের আজ মঙ্গলবার চতুর্থ দিনে থাকছে লোকসঙ্গীতের আয়োজন। সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান।
খেলাঘর সংগঠক হাসান শাহীনের শোকসভা ॥ শিশু সংগঠন খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক আবু হাসান শাহীনের শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় সোমবার। মৈত্রী মিলনায়তনে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের আয়োজনে ও খেলাঘরের সভাপতিম-লীর চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা পান্না কায়সারের সভাপতিত্বে শোকসভায় বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, ছড়াকার আলম তালুকাদার, ছড়াকার আখতার হুসেন, শিল্পী ধ্রুব এষ, ছড়াকার আমীরুল ইসলাম প্রমুখ। শোকসভার শুরুতে খেলাঘরের শিশু-কিশোররা আবু হাসান শাহীনকে নিবেদন করে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’ এরপর শোকসভায় আলোচকগণ প্রয়াত শাহীনের কর্মময় জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণ ও আলোচনা করেন।