(১৬ জানুয়ারির পর)
শফিউল্লাহ লিখেছেন, যেভাবে আমি উত্তর দিলাম তা ঠিক হয়নি। তবু তিনি বললেন, “স্যার, আমি জানি যে, আমি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলছি। কিন্তু স্যার, আমি এখানে নিজের জন্য বলতে আসিনি, আমি এখানে আপনার জন্য বলতে এসেছি। গাজী গোলাম মোস্তফা শত শত লোকের সামনে যা করেছেন তা মেনে নেয়া যায় না। তিনি যা করেছেন তার জন্য শাস্তি হওয়া দরকার। তিনি একজন অফিসার ও তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন হয়তো হত্যার জন্য। গাজী গোলাম মোস্তফার এই আচরণ affecting the morale of the troops. আপনি কেন অন্যের কুকাণ্ডের দায়িত্ব নেবেন?” যা হোক, রাষ্ট্রপতি ঘটনার গভীরতা হয়ত অনুধাবন করেননি। লিখেছেন শফিউল্লাহ, ‘তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। আমি রাষ্ট্রপতির বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম গাজী গোলাম মোস্তফার শাস্তি চেয়ে।’
এর দু’দিন পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তৃতীয় দিন বিপর্যস্ত ডালিম শফিউল্লাহর দফতরে এসে জানতে চাইলেন, গাজীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা। শফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন জানিয়ে বললেন, হয়ত শীঘ্রই কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডালিম এক পর্যায়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে টেবিলে চাপড়ে বললেন, “He while expressing his grief, at one stage became so emotional that he thumped on my table”. শফিউল্লাহ চিৎকার করে তাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ডালিম বেরিয়ে গেলেন।
আরও দু’দিন পর বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহকে ডেকে পাঠালেন তার অফিসে এবং প্রায় অভিযোগের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডালিম যে তার টেবিল চাপড়ে গেল তার তিনি কী করেছেন?’ এ প্রশ্নে শফিউল্লাহ হকচকিয়ে গেলেন। উত্তর দিলেন, ‘স্যার, মেজর ডালিম যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমার অফিসে এসে সে ইমোশনাল হয়ে গেছে। যা হোক আমার অফিসে সে যা করেছে তা হলো- an outburst of that emotion.’ শফিউল্লাহ লিখেছেন, তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জিজ্ঞাসায়। তারপর বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্যার, আপনি বিষয়টি জানলেন কীভাবে?’ রাষ্ট্রপতি বললেন তাকে, ‘শফিউল্লাহ, তোমার সদর দফতরে অনেক কিছু ঘটে যা তুমি জানো না কিন্তু আমি জানি।’ তারপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো, তোমার কিছু অফিসার বৈঠকখানায় তাজা অ্যামুনিশন রাখে?”
শফিউল্লাহ লিখেছেন, তিনি যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, তখন তার চিন্তায় ছিল শুধুই গাজী গোলাম মোস্তফার বিষয়টি। তার ভাষায়- “I was in some sort of aggressive mood, but with this type of question the President put me on the defensive. I did not expect this type of question from him! He caught me off guard and was on the offensive.”
গোলাম মোস্তফার সঙ্গে এসব প্রশ্নের কোন যোগসূত্র ছিল না। তবু শফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতিকে জানালেন তিনি বিষয়গুলো দেখবেন এবং যাওয়ার সময় রাষ্ট্রপতিকে আবারও অনুরোধ জানালেন, গাজীর বিষয়টি সুরাহা করার। তিনি জানালেন, বিষয়টির দ্রুত সুরাহা করা উচিত। কারণ তা “having a very bad impact on the morale of the entire army. গাজীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে শফিউল্লাহর ভাষায় “It might be beyond my control.” তিনি জানাচ্ছেন, রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে তিনি যখন বেরুচ্ছেন তখন তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না।
ফেরার পথে শফিউল্লাহ চিন্তা করছিলেন ডালিমের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু জানলেন কীভাবে? পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, দুটি উৎস থেকে তিনি খবর পেয়েছেন। এক. তার ডেপুটি জিয়াউর রহমানের অফিস, দুই. ডিজিএফআই। যেদিন ঘটনাটি ঘটেছে, সেদিনই রাষ্ট্রপতি বিষয়টি জেনেছেন। ডিজিএফআই একদিন পর খবরটি জানায়। ডিজিএফআইয়ের প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। তিনি রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন, সেনাপ্রধানকে নয়।
তাজা অ্যামুনিশনের ব্যাপারটাও জানলেন। ক্যাপ্টেন মতিন মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে গুলিভর্তি একটি বেল্ট সাজিয়ে রেখেছিলেন বসার ঘরে। এটি এমন কোন ব্যাপার ছিল না। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ব্রিগেডিয়ার রউফ তাকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন এই ধরনের স্মারক রাখা যায় না। কিন্তু তিনি তা করেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি পছন্দ করতেন না। কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তান ফেরত।
শফিউল্লাহ আবার রাষ্ট্রপতির কাছে গেলেন বিষয়টি আরও খোলাসা করতে। এটিও বললেন, রউফের উচিত ছিল আগে তাকে ঘটনাটি জানানো। কারণ মতিনের উর্ধতন অফিসার তিনি। ফেরার আগে আবারও তিনি অনুরোধ করেন গাজীর ব্যাপারে কিছু করার জন্য।
গাজীর ব্যাপারে যখন তিনি সরকারী সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছেন তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি পেলেন। সে চিঠিতে ডালিমকে বরখাস্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি ফের গেলেন রাষ্ট্রপতির কাছে, যাতে তিনি সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। সিদ্ধান্ত বাতিল হয়নি। তার মনে হয়েছিল সেনাবাহিনীর সামনে তাকে ছোট করা হয়েছে। তার ভাষায়- “By this order my command had been completely shattered. This dismissal order made me small and I was belittled in the eyes of my subordinates.” তখন তিনি পদত্যাগের কথাও ভেবেছিলেন। করেননি। কারণ তাতে সামগ্রিক কোন লাভ হতো না। বরং ভবিষ্যত সাফল্যের জন্য তিনি অপেক্ষা করা ভাল মনে করেছিলেন।
মেজর ডালিমকে তিনি নির্দেশটি জানান। ডালিম জানতে চান তিনি কী এমন করেছেন যার জন্য এমন ব্যবস্থা নেয়া হলো। শফিউল্লাহ জবাব দিতে পারেননি। ডালিমের বরখাস্তের নির্দেশ জানাজানি হলে অগ্নিতে যেন ঘি ঢালা হলো। কিছু অফিসার সরকার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করলেন। এর মধ্যে সোচ্চার ছিলেন জিয়ার পিএস মেজর নূর। এই ঘটনা জানানো হলো রাষ্ট্রপতিকে। পরদিন নূরের বরখাস্তের নির্দেশ এলো। শফিউল্লাহ লিখেছেন, “দুর্ভাগ্য যে, আমি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হলাম। আমার আর নৈতিক কোন অধিকার থাকল না বাহিনীকে আমার পাশে জড়ো করার। কারণ তাদের আশ্রয় দিতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার ডেপুটি জিয়া এর পূর্ণ সুযোগ নিলেন এবং তখনই তাদের প্রবক্তা [চ্যাম্পিয়ন] হয়ে উঠলেন। অধস্তনরা আমার ওপর বিশ্বাস হারাল।” [ও ধিং ঃযঁং ৎিড়হমবফ ভড়ৎ হড় ভধঁষঃ ড়ভ সরহব.”]
শফিউল্লাহর মতে, ডালিম নূরদের প্রতি যে ‘অবিচার’ করা হয়েছিল সেনাবাহিনীতে অসন্তোষের এটি ছিল একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুবিরোধীরা এরপর ডালিমকে তাদের ষড়যন্ত্রে জড়ায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৫ আগস্টের পর ডালিমদের যে প্রতিরোধ করা যায়নি তার জন্য কর্নেল শাফায়াত জামিল ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে দায়ী করেন।
শাফায়াত সম্পর্কে তার অভিযোগ, ১৫ আগস্ট সকালে তিনি শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দেন, ডালিমদের প্রতিরোধ করার। তিনি তা করেননি। এমনকি ডালিমকে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতেও বাধা দেননি। হয়ত শাফায়াত ডালিমের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। যে কারণে শাফায়াত তাদের প্রতিরোধ করেননি। ডালিম শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয় সৈন্য নিয়ে শফিউল্লাহর অফিসেও যান।
অভিযোগ করে তিনি আরও লিখেছেন, “যাদের ওপর আমি নির্ভর করতে পারতাম তারাই নিজস্ব স্বার্থের কারণে আমার নির্দেশ মানেননি। যে কারণে আমি যে মন্তব্য করছি তা হলো, শাফায়াত ছিলেন আমার একমাত্র শক্তি কিন্তু তিনি আমার সমর্থনে এগিয়ে আসেননি। আমার নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেননি। নির্দেশ না মেনে তিনি বরং গেছেন জিয়ার কাছে নির্দেশ নিতে। অন্যদিকে সিজেএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ওপর আমার পরিপূর্ণ বিশ্বাস ছিল, কিন্তু তিনি যে কাজ করলেন, তা তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই ১৫ আগস্ট দুপুরে তিনি বিদ্রোহী সৈন্যদের, ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টকে গোলাবারুদ ইস্যু করেন আমাকে না জানিয়ে। তার ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস তারপর কীভাবে রাখি? সেই থেকে আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হয়ে গেলাম। মোশতাক আমার এই দুর্বলতার সুযোগ নিলেন। অন্য কর্মকর্তা ও সৈন্যদের থেকে আলাদা করে এবং বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে ৭২ ঘণ্টা আটকে রাখেন বঙ্গভবনে।”
শফিউল্লাহ লিখেছেন, শাফায়াত হয় তাদের সঙ্গে ছিলেন অথবা তাদের প্রতি সমব্যথী কোন কর্মকর্তার নির্দেশ শুনছিলেন। বিদ্রোহীদের প্রতি সৈন্যদের সমবেদনা ছিল কিন্তু তারা যা করেছে তাতে সমবেদনা তাদের প্রাপ্য ছিল না। তার মতে “আমি যখন ৪৬ ব্রিগেডে গেলাম তখন দেখি সৈন্যরা স্থবির [আনমুভড]। বিদ্রোহীদের প্রতিরোধে আমি সৈন্য সংগ্রহ করতে পারিনি।”
পাঁচ.
‘বঙ্গবন্ধু হত্যা’ শীর্ষক অধ্যায়ে শফিউল্লাহ সেনাবাহিনীর খুঁটিনাটি অনেক বিষয় আলাপ করেছেন। ওইসব বিষয় বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। দু’-একটি বিষয়ের উল্লেখ করব।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা কুমিল্লার এক এনসিওকে গ্রেফতার করে। তিনি আপত্তিজনক কিছু লিফলেট বিলি করছিলেন। লিফলেটে সেনা বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের বাইরে। শফিউল্লাহ জানতে পেরেছিলেন যে, এর জন্য দায়ী জাসদ। এ প্রসঙ্গে তিনি ডিএফআই-এর কথা আলোচনা করেছেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তা ছিল সেনাপ্রধানের অধীন। রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় তা চলে যায় রাষ্ট্রপতির অধীন। তখন তিনি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে চেয়েছিলেন এবং তার অর্গানোগ্রামও দিয়েছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য শফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার রউফকেও দায়ী করেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় রউফ পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীতে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন কুর্মিটোলায় বন্দী তখন যেভাবেই হোক রউফ তার আস্থায় আসেন। সে জন্য রউফকে বঙ্গবন্ধু ডিএফআইয়ের প্রধান করেছিলেন। শফিউল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলামও এ ষড়যন্ত্রে জড়িত। বঙ্গবন্ধু গোয়েন্দা সংস্থার সীমাবদ্ধতা জেনে নুরুল ইসলামকে বলেছিলেন দ্রুত অর্গানোগ্রাম পাস করে দিতে। শফিউল্লাহর সামনেই নুরুল ইসলামকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। নুরুল ইসলাম সে নির্দেশ মানেননি। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব জামিল আহমদকে পরে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ডিএফআইয়ের প্রধান হিসেবে। ১৫ আগস্ট তার দায়িত্ব বুঝে নেয়ার কথা। সেদিনই তিনি নিহত হন।
রাষ্ট্রপতির কাছে অর্গানোগ্রাম বিষয়ে যেদিন আলোচনা করতে গিয়েছিলেন সেদিন তিনি শফিউল্লাহকে জানালেন, জিয়াউর রহমানকে তিনি পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। এ কথা শুনে খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন শফিউল্লাহ। কারণ তিনি খবরটি জানতেন না। তাই বঙ্গবন্ধুকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জানালেন, বিভিন্নজনের মাধ্যমে জিয়া তাকে খবর পাঠাচ্ছিলেন শফিউল্লাহকে যেন আরেক টার্মের জন্য সেনাপ্রধান না করা হয় [শফিউল্লাহর টার্ম শেষ হয়েছিল ৭.৪.১৯৭৫ সালে]। সেনাপ্রধান যেন জিয়াকে করা হয়। এসব তদ্বিরে কাজ না হওয়ায় জিয়া নিজে দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এবং একই অনুরোধ করেন। শুধু তাই নয়, এও জানান, তিনি বঙ্গবন্ধুকে আরও ভালভাবে সার্ভ (ংবৎাব) করতে পারবেন।
চলবে...