সুবল বিশ্বাস
নৌকার ছবি এঁকে স্বয়ং জাতির পিতার কাছ থেকে ‘নৌকা আনোয়ার’ খেতাব পেয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। শৈশব থেকেই বিচিত্র ঢংয়ে, নানা রঙে, নানা বর্ণের নৌকার ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন শিল্পজগতে প্রবেশ করেন। মাধ্যমিক স্কুলের পরীক্ষার খাতায় নৌকার ছবি এঁকে তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রংতুলিতে বর্ণবিভা ছড়িয়ে গেছেন তিনি। নদীতে পানির ঢেউ, কাঠের নৌকা, প্রাকৃতিক দৃশ্য, নৈসর্গিক দৃশ্যপট চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর নিপুণ হাতে। তাঁর আঁকা অসাধারণ সব ছবি দেখে বিমোহিত হয়েছেন নামীদামী চিত্রশিল্পীসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। প্রশংসাও কুড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু রাষ্ট্রনায়কের। এই ছবি এঁেক এঁকেই একদিন তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে এসেছিলেন।
সেই ১৯৪১ সালে তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) কুরপালা গ্রামের প্রখ্যাত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তাঁর পিতা কাজী আবুল হোসেন ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর ও মা অহিদুন্নেছা। ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। কাজী আনোয়ার হোসেন গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করলেও শৈশব থেকে পরিবারের সঙ্গে মাদারীপুর শহরেই বসবাস শুরু করেন। এ শহর ও শহরতলির বিচিত্র শ্যামলিমা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা। এ অঞ্চলের নৈসর্গিক দৃশ্যপট তাঁর হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে শিশু বয়সেই।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন কাজী আনোয়ার হোসেনের হাতে আঁকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি ইন্দ্রিরা গান্ধীকে উপহার দেয়া হয়। ছবিটি বর্তমানে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীর মডার্ন আর্ট গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই গুণী শিল্পীকে আদর করে ‘নৌকা আনোয়ার’ বলে ডাকতেন। সেই থেকে তিনি নৌকা আনোয়ার নামে এতদাঞ্চলে পরিচিতি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তিনি সারাজীবন নৌকার ছবি এঁকে গেছেন বলে তাঁর ছেলে কাজী আশিকুর হোসেন অপু জানান।
শিক্ষাজীবনে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভের পর ছবি আঁকা আনোয়ার হোসেনের স্বল্প আয়ের অবলম্বন ও জীবন-জীবিকা হয়ে দাঁড়ায়। মন-পবনের নৌকার টানে বাংলার নদী নিসর্গ আর নৌকা ক্রমশ বিচিত্র বর্ণ-ব্যঞ্জনায় রূপ পেতে থাকে তাঁর তুলি আর জলরঙে। পরিণত বয়সে এসে তিনি মিনিয়েচার ছবির দিকে ঝুঁকে পড়েন। ছবির উপকরণের ক্ষেত্রে আধুনিককালের চিত্রশিল্পীদের মতো অভিনব প্রবণতা লক্ষণীয়। বলা যায়, সে ধারায় শিল্পী আনোয়ার হোসেনের কাজেও বৈচিত্র্য যথেষ্টই। ক্যানভাস হিসেবে সহজ উপকরণ ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি। দিয়াশলাইয়ের খাপের কাঠের অংশের ওপর নৌকা এবং নদীর দৃশ্যও চিত্রায়িত করেন, যা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কারণে আজও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এছাড়া ছবির উপকরণ হিসেবে আঠা, গাছের পাতা, ছাল, আমের বীজ, মাছের কাঁটা, হাড়, টুকরা কাপড় ইত্যাদি ব্যবহার করতে থাকেন। সীমিত রঙের ব্যবহারসংবলিত তাঁর এ ধরনের শিল্পকর্মগুলোর সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁর অমর শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কাজের মিল পওয়া যায়। জীবন নৌকার যাত্রী হয়ে পাশ্চাত্যে পাড়ি জমানোর সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের সাড়া জাগানো ‘দি ফাদার’ ছবির মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়কারী তৎকালীন ইউএনডিপির ঢাকা অফিসের এক কর্মকর্তা মার্কিন নাগরিক জন এ্যাডাম নেপিয়ার ওই সিনেমায় কাজী আনোয়ার হোসেনের বেশকিছু ছবি ব্যবহার করেন। তিনি আমেরিকায় ফেরার সময় শিল্পীর আঁকা বেশকিছু ছবি সঙ্গে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর ছবি বহু দর্শকের আগ্রহ সৃষ্টি করে। আহ্বান আসে আমেরিকায় যাওয়ার। কিন্তু শ্যামল বাংলার নৌকার রহস্য উন্মোচন তো তখনও অনেকটাই বাকি রয়ে গেছে শিল্পীর। তাই দেশে বসে ছবি আঁকার জন্য তিনি আমেরিকায় যাননি।
কাজী আনোয়ার হোসেনের আঁকা ছবিগুলো দেখে বোঝা যায়, তাঁর আঁকা চিত্রজগৎ যেন নৌকার এক নিরবচ্ছিন্ন মিছিল। কখনও ঘাটে বাঁধা নৌকার সারি, কখনও ভাসমান নৌকা, একটি অথবা এক জোড়া অথবা অনেক মাছ ধরার জেলে নৌকা, পানসি নৌকা, খেয়া নৌকা, ছিপ নৌকাসহ বিচিত্র ধরনের অজস্র নৌকা নানা বর্ণচ্ছটায় মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর ক্যানভাসে। নৌকার মাধ্যমে জীবনের গতিশীলতার যে রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, তার পাশাপাশি সেই নৌকারই মাঝিমাল্লা কিংবা চা-দোকানিসহ আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনযাত্রার দৃশ্য উঠে এসেছে তার চিত্রকর্মে। এর মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে তাঁর সহজ-সরল জীবন দর্শন আর কর্মমুখর প্রশান্ত বর্ণবৈভব। কাজী আনোয়ার হোসেনের আঁকা ছবি অনেক বিশিষ্টজন সংগ্রহে রেখেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধী, নেপালের রাজা, ফিলিস্তিনের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত, যুগোসøাভিয়ার বিশ্বনেতা মার্শাল টিটো, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও কূটনীতিক ও শিল্পানুরাগী ব্যক্তিবর্গের সংগ্রহশালায় রয়েছে শিল্পীর আঁকা ছবি। প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সমাদ আজাদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁর শিল্পকর্মগুলো বাইরে সফরে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যেতেন উপহার দেয়ার জন্য। এই গুণী শিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন ২০০৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নিজ বাড়িতে ছবি আঁকার সময় রংতুলি হাতে থাকাবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
তাঁর বড় জামাতা মীর এনামুল ইসলাম জানালেন, শিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেনের আঁকা সহস্রাধিক ছবি এখনও অবিক্রীত। তাঁর ইচ্ছা ছিল ছবিগুলো বিক্রি হলে বিক্রয়লব্ধ অর্থ আর্তমানবতার সেবায় ব্যয় করার। মাদারীপুর থেকে এবার দাবি উঠেছে এই গুণী চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেনকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করার। তাই একুশে পদক-২০১৬ প্রদানের জন্য মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে মনোনয়নের আবেদন করা হয়েছে। এ আবেদনে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, “চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন শুধু মাদারীপুর নয়, তিনি সারা বাংলার গর্ব। যিনি নিপুণ হাতে সারাজীবন নৌকার ছবি এঁকেছেন, তাঁকে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। ইতোমধ্যে তাঁর নামে মাদারীপুর শহরে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। তাঁকে মাদারীপুরবাসী সারাজীবন মনে রাখবে। সেই সঙ্গে মাদারীপুরবাসীর দাবি, চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেনকে খোদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আদর করে ‘নৌকা আনোয়ার’ বলে ডাকতেন, তাকে মরণোত্তর একুশে পদক-২০১৬ দেয়া হোক। এতে শুধু মাদারীপুরবাসী নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত হবে।”