
হঠাৎ করে উত্তরাঞ্চলে কৃষিজমি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তামাক চাষ লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। রংপুর কৃষি অঞ্চলে তিন জেলা লালমনিরহাট, রংপুর ও নীলফামারীতে গত বছর (২০২৩-২০২৪) তামাক চাষ হয়েছিল ১৩ হাজার ৩৪৯ হেক্টর জমিতে। সেই তামাকের পরিধি বেড়ে এবার (২০২৪-২০২৫) চাষ হয়েছে ১৮ হাজার ৭৩৪ হেক্টর জমিতে। এর আগে ২০২২-২০২৩ সালে তামাক চাষ হয়েছিল ১০ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক সরবরাহ করায় তামাক চাষ বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, রংপুর অঞ্চলের উৎপাদিত তামাকের ৬০ শতাংশ আসে লালমনিরহাট থেকে। রংপুর জেলা থেকে আসে ২৫ শতাংশ তামাক ও নীলফামারীতে ১৫ শতাংশ। এবার এর পরিধি বেড়েছে কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায়। দেশি-বিদেশি কয়েকটি তামাক কোম্পানি এখানে রীতিমতো তামাকের বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তুলেছে।
এ অঞ্চলের লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী, হাতীবান্ধা উপজেলাকে বলা হয় 'তামাকের রাজধানী'। তামাক চাষিরা বলছেন আগামী বছরে তামাক চাষ আরও বাড়বে। পাশাপাশি তামাকের দামও বাড়ছে। কোম্পানির লোকজন এসে তামাক কিনে নিয়ে যায়। তামাকের বাজারদর নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না।
রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল কাদের (৭০) বলেন, তিনি গত ৩৯ বছর ধরে তামাক চাষ করছেন। তবে এ বছরের মতো ব্যাপক জমিতে তামাক চাষ আগে কখনো দেখেননি। তিনি আরও বলেন, 'এ বছর অনেক কৃষক নতুনভাবে তামাক চাষ করেছেন।
তামাক কোম্পানি থেকেই বীজ, সার, কীটনাশক ও সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। গেল বছর তামাকের বাজারদর বেশি ছিল। তাই এ বছর কৃষকরা তামাক চাষে আরও বেশি ঝুঁকেছেন।' তিনি উল্লেখ করে বলেন, একসময়ে তামাকই ছিল রংপুর অঞ্চলের প্রধান ফসল। ১৯০৮ সালে রংপুর সদরের বুড়িরহাটে ৫০ একর জমিতে স্থাপিত হয় তামাক গবেষণা কেন্দ্র। তবে পরবর্তী সময়ে তামাকের ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় ২০০৫ সালে কেন্দ্রটি পাল্টে পরিণত হয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে।
রংপুর কৃষি অঞ্চলের অফিস সূত্রে জানা যায় চলতি বছরে (২০২৪-২০২৫) ৫ জেলায় তামাক চাষ হয় ১৮ হাজার ৭৩৪ হেক্টর জমিতে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে তামাক চাষ হয়েছিল ১৩ হাজার ৩৪৯ হেক্টরে ও ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তামাক চাষ হয় ১০ হাজার ৮১৫ হেক্টর জমিতে।
এতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের হিসাব মতে দেখা যায় চলতি বছরে তামাক চাষ বৃদ্ধি পায় ৭ হাজার ৯১৯ হেক্টরে। যা গত বছর বৃদ্ধি ছিল ৫ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে বেশি। সূত্র মতে চলতি বছরে লালমনিরহাট জেলায় ১৫ হাজার ৫৭৫ হেক্টরে তামাক চাষ হয়। যা ২০২৩-২০২৪ বছরে চাষ হয়েছিল ৯ হাজার ৮৬৫ হেক্টরে। এতে শুধু লালমনিরহাট জেলায় তামাক চাষ বৃদ্ধি পায় ৫ হাজার ৭১০ হেক্টরে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এই জেলায় তামাক চাষ হয়েছিল ৬ হাজার ৮৪৫ হেক্টরে। অর্থাৎ দুই বছরে লালমনিরহাটে তামাক চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমিতে।
রংপুর জেলায় দেখা যায়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৫০ হেক্টরে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৮৪০ হেক্টরে এবং চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে তামাক চাষ হয় ১ হাজার ৮৩৫ হেক্টরে। এতে ১৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ কমেছে।
এদিকে নীলফামারী জেলায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তামাক চাষ হয়েছিল ২ হাজার ১০৫ হেক্টরে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৪৪ হেক্টরে এবং চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ১ হাজার ২৩৯ হেক্টরে। যা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৪৬১ হেক্টর এবং ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ৪০৫ হেক্টরে তামাক চাষ কমেছে। এর মধ্যে ডিমলা উপজেলাকে তামাক চাষ মুক্ত এলাকা ঘোষণা করায় গত ৩ বছর ধরে সেখানে তামাক চাষ হচ্ছে না।
কুড়িগ্রাম জেলায় ২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কোন তামাক চাষ না হলেও চলতি বছরে (২০২৪-২০২৫) তামাক চাষ হয়েছে ৪১ দশমিক ৪ হেক্টরে। গাইবান্ধা জেলায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কোন তামাক চাষ না হলেও ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১৫ হেক্টর এবং চলতি বছর (২০২৪-২০২৫) ৪৩ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তবে অনেক কৃষক জানান, কৃষি বিভাগের তথ্যের চেয়ে দ্বিগুণ জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাক কোম্পানিগুলো অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তামাকের চাষ বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
নীলফামারীর লক্ষ্মীচাপ, ডোমারের হরিণচড়া গ্রামের কৃষক প্রবীর চন্দ্র বর্মণ (৬৫) ও ইসমাইল হোসেন (৫৫) বলেন, 'তামাক জমির উর্বরতা নষ্ট করে। এটি মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এর পরও কৃষকরা তামাক চাষে বেশি আগ্রহী। কারণ, অন্য ফসলের তুলনায় তামাকে লাভ বেশি। তামাক কোম্পানিগুলো যেভাবে কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে তাতে আগামীতে তামাকের চাষ আরও বাড়বে,' বলেন তিনি।
কৃষি বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জানিয়ে বলেন, কৃষকরা তামাক পণ্যটি বিক্রির নিশ্চয়তা পাচ্ছেন। এছাড়া কোম্পানি থেকে বীজ, সার সবকিছুই পাচ্ছে। পাশাপাশি আলু চাষ করে কৃষকরা লোকসানে পড়ছে। সূর্যমুখী চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বাজারজাতকরণে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় কৃষকরা সূর্যমুখী চাষে অনীহা প্রকাশ করছে।
তিনি বলেন, আমরা তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো সরেজমিন দেখাচ্ছি। অথচ লালমনিরহাট জেলায় তামাকের চাষ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এবার বোরো ধানের আবাদ এখানে কম। এই জেলার আদিতমারী, হাতীবান্ধা উপজেলায় তামাক চাষ উদ্বুদ্ধ করণের জন্য কোম্পানিগুলো তাদের শাখা খুলেছে। এখান থেকেই কোম্পানিগুলো তাদের বিষদৃষ্টি পাশের জেলাগুলোতে সম্প্রসারণ করেছে।
একেবারেই নতুন করে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার কৃষকদের মাধ্যমে তামাক চাষে সফল হয়েছে। এখন সেখানকার দেশীয় ফসল আলু, কলা, তিল-তিসি এমনকি ধানী জমিতেও তামাকের বিষাক্ত ঘ্রাণ, বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার মিয়াপাড়া এলাকার তামাকের ভালো ফলন হচ্ছে। এখন কোম্পানিগুলো এসে সকল সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তামাক চাষে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
বিবিএস তথ্যমতে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৯৩ হাজার ১০৭ একর জমিতে তামাকের উৎপাদন ছিল ৮৬ হাজার ৫৮৩ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক লাখ এক হাজার ১০০ একর জমিতে উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৮১৪ টন। ফলে এক অর্থবছরের ব্যবধানে দেশে আবাদ বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ।
অন্যদিকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। বিবিএসের ইয়ারবুক অব এগ্রিকালচারাল স্ট্যাটিস্টিকস-এর তথ্যমতে, দেশে সবচেয়ে বেশি তামাক উৎপাদনকারী জেলা কুষ্টিয়া। এ জেলাটি থেকেই আসছে দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে লালমনিরহাট। এ জেলায় উৎপাদন হচ্ছে দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে মেহেরপুর জেলা। তামাক উৎপাদনে একসময় পাহাড়ি অঞ্চল এগিয়ে থাকলেও এখন সেটির আবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। বিশেষ করে উত্তরের তিন জেলায়।
অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, 'কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যের চেয়ে দ্বিগুণ জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাক কোম্পানিগুলো অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তামাকের চাষ বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। তামাক কোম্পানিগুলোর অবাধ কার্যক্রমে লাগাম টানতে হবে। কোম্পানি থেকে সহযোগিতা দেওয়া বন্ধ হলে কৃষকরা তামাক চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। এজন্য সরকারের শক্ত পদক্ষেপ দরকার।'
রংপুর অঞ্চল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, এই অঞ্চলে তামাক চাষ বেড়ে যাওয়া নিয়ে তারাও চিন্তিত। সরকারিভাবে তামাক চাষ নিষিদ্ধ না হওয়ায় কৃষি বিভাগ শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
উন্নত দেশগুলো তামাক চাষ বন্ধ করায় বাংলাদেশে এটা বেড়ে গেছে। তামাক কোম্পানিগুলো রংপুর অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছে। তিনি আরও বলেন, 'কৃষকের কাছে তামাক অর্থকরী ফসল হলেও এটি মাটি, পরিবেশ ও মানব-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এটি কৃষির জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।'
আফরোজা