
পানি জাদুঘরে এভাবেই বোতলে বিভিন্ন নদীর পানি রাখা হয়েছে
পটুয়াখালীর কলাপাড়া এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। দেশে প্রথমবারের মতো ‘পানি জাদুঘর’ স্থাপিত হয়েছে এখানে। উপজেলার সবজি ভা-ারখ্যাত নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাখিমারায় কুয়াকাটাগামী মহাসড়কের পাশে এ জাদুঘরের অবস্থান। ব্যতিক্রমধর্মী এ জাদুঘরটি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দর্শনার্থীর আনাগোনা থাকছে। নদী ও পানি সম্পর্কিত নতুন কিছু জানার সুযোগ রয়েছে এখানে। তবে এই ঘরটির আধুনিকায়নসহ আরও ভালো পৃষ্ঠপোষকতার দরকার বলে মনে করছেন দর্শনার্থীরা।
নদী ও পানি সম্পদ রক্ষায় সরকার ও নীতি নির্ধারকদের আরও উদ্যোগী করা, মানুষকে সচেতন করা এবং নদী ও পানি সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে ‘পানি জাদুঘরের’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রধান ধারক নদী ও পানি সম্পদ। দেশটিতে রয়েছে নদী ও পানির সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ধারাবাহিকতা। কিন্তু জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনজনিত কারণে নদী ভরাটও হয়ে গেছে। নদী হারিয়ে গেছে মানুষের দখল দৌরাত্ম্যে। মিষ্টি পানির প্রধান উৎস নদী তার উৎসস্থল হারিয়ে ফেলছে। এর প্রভাবে জীবন-জীবিকা হারাচ্ছে মানুষ।
কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় ধেয়ে আসছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ। পশু-পাখির অভয়ারণ্য, মানুষের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে নদীপথের দ্রুত বিলোপ। এর নেতিবাচক প্রভাব এবং নদী রক্ষায় নেওয়া সকল বিষয় উপজীব্য করে উপস্থাপন করা হয়েছে জাদুঘরটিতে।
মনোরম লোকেশনে জাদুঘরটির সামনে স্থান পেয়েছে নদীপথে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেওয়ায় পানির প্রবাহ থমকে পরিণত হওয়া বালুচরের দৃশ্য। যেখানে শোভা পাচ্ছে নদীতে নৌকা চলাচলের পথ স্থায়ীভাবে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার দৃশ্যপট। বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে জাদুঘরের মূল দরজায়। জাদুঘরে রাখা হয়েছে দেশের প্রধান মেঘনা, হালদা, গড়াই, বুড়িগঙ্গা, পায়রা, যমুনা, পদ্মা, তিস্তা, কীর্তনখোলা, আন্ধারমানিক নদী থেকে সংগৃহীত পানির নমুনা। মোট ৮৭টি নদীর পানির নমুনা রাখা হয়েছে। যেখানে ৩০টি বহির্দেশের নদীর পানি। বাকি ৫৭টি দেশের বিভিন্ন নদীর। নদীপথে চলা নৌকা। নদীর পানি ব্যবহারের দৃশ্যপট।
নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকার বিভিন্ন উপকরণ- মাছ ধরার চাঁই, বিভিন্ন ধরনের জাল, ঝুড়ি, খাড়ই, কাঠের সামগ্রী শোভা পাচ্ছে। রয়েছে নদীপথে চলাচল করা বিভিন্ন ডিজাইনের নৌকার চলাচল। আঞ্চলিক নদীপথ ও তার ওপরে সরকারের চলমান ব্রিজ নির্মাণের দৃশ্যপটসহ সামাজিক ম্যাপ উপস্থাপিত রয়েছে। রয়েছে দেশ-বিদেশের নদীর পরিসংখ্যান। নদীপথের নিয়ন্ত্রক দেশের নামসমূহ। নদীর উৎসস্থল।
জাদুঘরের তথ্যভা-ার থেকে জানা গেল, বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে। শত বছর আগে এর সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। নদীর সংখ্যা কমায় নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বাঁধ, দূষণসহ নানা কারণে নদী হারিয়ে যাওয়ায় জীবন-জীবিকায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের পানি সম্পদ ও নদী বাঁচাতে নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন নানা ঘোষণায় এর গুরুত্ব তুলে ধরলেও সরকারের উদ্যোগ রয়েছে সীমিত পরিসরে। এরই প্রেক্ষাপটে নদী ও পানি সম্পদ রক্ষায় উন্নত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পানি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে।
পানি জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার কারণে মানুষ নদীর প্রয়োজনীয়তা, নদী ভরাট হওয়ায় বিপর্যয় ক্ষেত্রসমূহের ভয়াবহতা দেখতে ও জানতে পারছেন। ফলে নদী ও পানি সম্পদ রক্ষায় সরকার ও নীতিনির্ধারক মহল আরও উদ্যোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ সচেতন হচ্ছেন। এসব বাস্তবতা দৃশ্যমান করতেই এ জাদুঘরের নির্মিত হয়েছে। পানি সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করছে এ জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার কারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘নদী মরে গেলে বাংলাদেশ মরে যাবে। কারণ পানি ও নদীর জন্যই বেঁচে আছে বাংলাদেশ। অথচ মানুষই এই নদীগুলোকে মেরে ফেলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পানি জাদুঘরে মূলত এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। নদীর কথা, পানির কথাকে উপজীব্য করে এই পানি জাদুঘর।
এই জাদুঘর, মানুষকে, সরকারকে, নতুন প্রজন্মকে সচেতন করবে’। এই গুণী শিক্ষক ২০১৪ সালে জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উন্নয়ন সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় সংস্থা উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘ তাদের নিজস্ব জমিতে এবং ঘরে এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিবছর এখানে এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হয়।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিভিন্নদিক তুলে ধরে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কথা তুলে করা হয়েছে জাদুঘরের অভ্যন্তরে। যেমন বাঁধ, পরিবেশগত বিপর্যয়সহ নানা করণে নদী মরে গেছে, মরে যাচ্ছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে দিনকে দিন। এর ফলে নদী পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আমরা চাই নদীকে নদীর মত বাঁচতে দিতে। তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য সচেতন হতে হবে আমাদেরই। সে কারণেই এই পানি জাদুঘর। এমন সব সচেতনতার কথা শোভা পাচ্ছে। নতুন প্রজন্মেও কাছে এসব মেসেজ তুলে ধরা হয়েছে।
উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘের সভাপতি ও পানি জাদুঘরের সচিব জয়নাল আবেদীন জানান, মানুষ জীব-জন্তু কিংবা পশু-পাখির জাদুঘর দেখেছে। কিন্তু পানি জাদুঘরের নাম আগে কেউ শোনেনি। এর গুরুত্ব বোঝা তাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য খুবই জরুরি। জাদুঘরটিরর তত্ত্বাবধায়ক লিপি মিত্র জানান, বর্তমানে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এটি শোভা বর্ধনে প্রবেশপথসহ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন।
প্রয়োজন একটু সংস্কারের। বর্তমানে সপ্তাহে বুধবার থেকে সোমবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি পরিদর্শনের সুযোগ রয়েছে। মাত্র ২০ টাকা দর্শনীর বিনিময় এই ভিন্নতর জাদুঘরটি দেখার সুযোগ মিলছে কুয়াকাটায় ভ্রমণে আসা পর্যটক-দর্শনার্থীর।
ব্যতিক্রমধর্মী ‘পানি জাদুঘরটির’ সুবাধে শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠী নয়, কুয়াকাটাগামী পর্যটক-দর্শনার্থী ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়। ঘুরে-ফিরে দেখেন আগতরা জাদুঘরটির ভেতর-বাইরে। জানতে চাচ্ছেন কেনইবা পানি জাদুঘর। মোটকথা কলাপাড়ার পাখিমারার পানি জাদুঘরটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে এ জনপদ থেকে অন্য জনপদে।