
পাবনা-কুষ্টিয়া সীমানা ভাগের জটিলতায় দুই জেলার ১৮ গ্রামবাসী যুগ যুগ ধরে নানা দুর্ভোগে দুঃখ-কষ্টে দিনযাপন করছেন। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে তাদের না আছে ভালো রাস্তা, না আছে নাগরিক সুবিধা। কাগজ-কলমে এক জেলার বাসিন্দা হলেও হাটবাজার, শিক্ষা, চিকিৎসা ও দৈনন্দিন জীবন- যাপন অন্য জেলায়। সীমানা ভাগাভাগিতে কুষ্টিয়ার ১১ গ্রাম পদ্মার এপারের পাবনা সদরের সঙ্গে আর পাবনার ৭টি গ্রাম পদ্মার ওপারে কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার নিকটে চলে যায়। এসব গ্রামবাসীকে নানা দুর্ভোগে পদ্মা পাড়ি দিয়ে নিজ জেলা উপজেলা সদরে এসে থানা কোর্ট-কাছারি ও ভূমি সেবা নিতে হচ্ছে। শহর থেকে প্রত্যন্ত চরে যাতায়াতের বিড়ম্বনা ও প্রশাসনিক নির্লিপ্ততায় দুই জেলার ১৮ গ্রামের উন্নয়নবঞ্চিত মানুষ এখন তাদের দুর্ভোগের সমাধান চান। তাই তারা সংকট অবসানে নিকটস্থ জেলায় অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলছেন।
পাবনা-কুষ্টিয়া সীমানা ভাগের সময় অদ্ভুতভাবে যেন ভূমি বণ্টন হয়েছে। পাবনা শহরের সন্নিকটে কুষ্টিয়ার ভূখণ্ড। আবার কয়েকশ গজ দূরে পাবনার ভূখণ্ড। আবার পদ্মার ওপারে কুষ্টিয়াতেও পাবনার ভূখণ্ড। এ এলোমেলো ভূখণ্ডে যারা বসবাস করছেন তারা যেন নিজভূমে পরবাসী। পাবনা সদর উপজেলার গা ঘেঁষে কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার চরসাদিপুর ইউনিয়ন। এখান থেকে পাবনা শহরের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। আর উপজেলা সদর কুমারখালি প্রায় ১৭ কিলোমিটার, কুষ্টিয়া শহর ২৯ কিলোমিটার। উত্তর ও পশ্চিমে পাবনার হেমায়েতপুর ও সদর উপজেলার দৌগাছি ইউনিয়ন। ১৯৯৮ সালে গঠিত প্রায় ২৫ বর্গমাইল ইউনিয়নের আরোয়াবান্ধা, গোবিন্দপুর, সাদিপুর, ঘোষপুর, চুলকানিরহাট, কাদেরহাট, ভবানীপুরসহ ৯ গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। চরসাদীপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামবাসী পাবনা সদরের হেমায়েতপুরের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করেন। চর সাদিপুরের বাসিন্দা জেলা উপজেলা যাতায়াত করেন ৬ কিলোমিটার পদ্মা পাড়ি দিয়ে। বর্ষা মৌসুমে ইঞ্জিনচালিত নৌকাতে পদ্মা পাড়ি দিতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে নদীর অধিকাংশ চর জেগে উঠায় ইজিবাইক, বাইসাইকেল মোটরসাইকেল ও নৌকায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত অর্থ ও চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ইউনিয়ন বাসিন্দারা হাট-বাজার, শিক্ষা চিকিৎসা সবই পাবনা শহরের ওপর নির্ভরশীল।
তেমনি পাবনার সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নের চরভবানীপুর, খাসচর, কণ্ঠবজরা, ধাবড়াকোল, বলরামপুর ও দোগাছি ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের চরভবানীপুর ও খাসচর ধোবড়াকোল গ্রাম পদ্মার ওপারে কুষ্টিয়ার কুমারখালির নিকটে অবস্থিত। দোগাছির ৯ নং ওয়ার্ডের গ্রাম ২টিতে আড়াই হাজার ভোটারের বসবাস। পাবনার ৭টি গ্রামের বাসিন্দারা হাট-বাজার চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন জীবন-যাপন সবই কুমারখালি ও কুষ্টিয়ার ওপর নির্ভরশীল। শুধুমাত্র জমির কাগজপত্র, থানা কাছারিতে পাবনা শহরে আসতে হচ্ছে। যেদিন জেলা শহরে আসতে হয় তার আগে তাদের চোখের ঘুম হারিয়ে যায়। এ ৭টি গ্রামের বাসিন্দারা কয়েক কিলোমিটার দূরের শিলাইদহ ঘাটে এসে খেয়া নৌকা পাড়ি দিয়ে পাবনায় আসতে হয়। বর্ষায় সমস্যা না হলেও শুষ্ক মৌসুমে তাদের অনেক দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। শহর থেকে প্রত্যন্ত চরে বসবাস করায় তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। চরের প্রত্যন্ত এলাকায় রাস্তাঘাটের তেমন উন্নয়ন হয়নি। এসব গ্রামের অধিবাসীরা হাট-বাজার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কুমারখালি ও কুষ্টিয়া শহরের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ভাড়েরা ইউপি সচিব সেলিম উদ্দিন জানান, ইউনিয়নের পদ্মা পারের প্রত্যন্ত ৭টি গ্রামের অধিবাসীরা নানা প্রতিকূলতায় বসবাস করছে। তাদের ইউপি কার্যালয় বা জেলার কোর্ট-কাছারিতে সেবা নিতে হলে পদ্মা পাড়ি দিয়ে আসতে হচ্ছে। যা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় দরিদ্রদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
কুষ্টিয়ার চরসাদিপুর ইউনিয়নে রবিবার পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় ইউনিয়নের প্রধান সড়কের রাস্তার ইট-খোয়ার কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতিদিন পদ্মা থেকে বালু মাটির ট্রাক রাস্তা দিয়ে চলাচল করায় ইট-সুরকি বিলীন হয়ে কাঁচা রাস্তায় রূপ নিয়েছে। রাস্তায় ধুলার স্তর পরায় এটি যে পাকা রাস্তা তাও বোঝা যায় না।
রাস্তাটি খানা-খন্দে এমনই অবস্থা একটু অসতর্ক হলেই যেন মারাত্মক বিপদের সংশয় সৃষ্টি করছে। সাদিপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল বড় একটি খালের ওপর একটি সেতু থাকলেও সংযোগ সড়ক নেই। যদিও যোগাযোগে খালটি গ্রামকে দুইভাগে ভাগ করেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খালের ওপর সেতু নির্মাণ হলেও সংযোগ সড়ক আজও হয়নি। তাই সেতুটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সেতুর দুইপাশের ১০ গ্রামের বাসিন্দা পানি মাড়িয়ে খাল পারাপার হচ্ছেন। দীর্ঘকাল এভাবে চললেও কেউ যেন দেখার নেই। চরসাদিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক জানান, রাস্তাঘাটের এমন দুর্বিষহ অবস্থায় গ্রামে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ আসতে চায় না। এখানে চায়ের দোকানে কথা হয় রমজান আলী, হামিদ লোকমান আর সুরুজ আলীর সঙ্গে। তারা উপজেলা কুমারখালি ও জেলা শহর কুষ্টিয়ায় যাতায়াতে তাদের চরম দুর্ভোগের কথা শোনালেন। কথা প্রসঙ্গে তারা এও বললেন, সীমানা জটিলতা নিরসনে বিগত সরকার আমলে কুষ্টিয়ায় দুই জেলায় ডিসিদের নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তারা বৈঠক করলেও আজও সমাধা হয়নি। তাদের দাবি, নিকটের জেলার সঙ্গে তাদের অন্তর্ভুক্তি করা হোক।
কথা বলি সাদিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বদর উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি ছাত্রদের বড় সমস্যার কথা জানিয়ে বলেন, এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্র নদীর ওপারে তাই সময়মতো কেন্দ্রে পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বাসা ভাড়া করে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। তা ব্যয়বহুল হওয়ায় এলাকার শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে অধিকাংশই পাবনার স্কুলে চলে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই পাবনার ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেল। এলাকায় ঘুরে ঘুরে যা জানলাম, কুমারখালী কুষ্টিয়ার মানুষ হয়েও এখানে অনেক মানুষ আছেন যারা পদ্মা পাড়ি দিয়ে আজও নিজ উপজেলা জেলা শহরের মুখ দেখেননি। এখানকার সবকিছুই পাবনা শহরের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
চরসাদিপুর পদ্মার ঘাটে গিয়ে দেখলাম কোথায় পানি কোথায় ঘাট। যতদূর চোখ যায় শুধুই ধু ধু বালিচর। চরের ওপর দিয়ে কেউ হেঁটে কেউবা ইজিবাইক অটোতে সাইকেল মোটরসাইকেলে খেয়াঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খেয়া পার হয়ে তারা কুষ্টিয়া ও কুমারখালি যাচ্ছেন। পদ্মায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার চর পাড়ি দিয়ে তারপর নৌকায় ১ দেড় কিলোমিটার গেলেই কুষ্টিয়ার শিলাইদহঘাট। চরসাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদ সচিব আবু সোহেল মোহম্মদ রানা জানান, প্রতিদিন চর পাড়ি দিয়ে আসতে অনেক কষ্ট হয়। তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি সেখানে পুলিশ ক্যাম্প, পোস্ট অফিস ও ব্যাংক স্থাপনের দাবি জানান। চরসাদিপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. মেছের আলী জানান, পদ্মা মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে আছে। নদীর কারণেই মানুষের জীবনমান এখনো অনুন্নত। এসব নিয়ে বহুবার ইউএনও, ডিসি, এমপিদের সঙ্গে কথা বলেছি।
প্রত্যন্ত চরাঞ্চল ঘুরে মনে হয়েছে দুই জেলার চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যুগের পর যুগ অপেক্ষার পরও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন দূরের কথা স্বাভাবিক জীবনাচরণ থেকেও বঞ্চিত হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ। চরাঞ্চলের মানুষ চায় যাতায়াতের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি, চায় স্বাভাবিক জীবন-যাপন। অবস্থানের ভিত্তিতে নিকটের জেলার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিই হতে পারে চরাঞ্চলের মানুষের এ সংকট সমাধানের একমাত্র উপায়। আর এজন্য পাবনা-কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ আজ সময়ের দাবি বলে তারা মতামত ব্যক্ত করেছেন।
প্যানেল