
ছবি: সংগৃহীত
মহেশখালী দ্বীপের প্রায় ছয় লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এখন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে সিজারিয়ান সেকশন, জেনারেল সার্জারি ও নবজাতক সেবা। চিকিৎসক ও নার্সের ঘাটতি, জরুরি চিকিৎসার অপ্রতুলতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে দ্বীপের মানুষ চরম বিপদের মুখে পড়েছেন। এখনই জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া না হলে, সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা থেকেও প্রাণহানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০২২ সাল থেকে হেলথ অ্যান্ড জেন্ডার সাপোর্ট প্রজেক্ট (HGSP)-এর আওতায় চালু থাকা সিজারিয়ান সেকশন, জেনারেল সার্জারি ও নবজাতক সেবা (এনআইসিইউ) কার্যক্রমের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪-এ শেষ হয়ে গেছে। প্রকল্পের আওতায় ৮ জন চিকিৎসক, ১০ জন নার্স এবং ১৫ জন সাপোর্ট স্টাফ হাসপাতালটিতে কর্মরত ছিলেন। তাদের সহায়তায় মহেশখালী ও আশপাশের এলাকার মানুষ জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে আসছিলেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাহফুজুল হক জানিয়েছেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ১ জানুয়ারি ২০২৫ থেকে এসব গুরুত্বপূর্ণ সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রোগীদের চিকিৎসা নিতে এখন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মহেশখালী হাসপাতালকে ১০০ শয্যায় উন্নিত করণ অত্যন্ত যৌক্তিক ও মৌলিক দাবি। এটা হওয়া উচিত। এই হাসপাতাল ১০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার ক্রাইটেরিয়া পূরণ করেছে অনেক আগেই, এখানে ৫০ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি থাকে প্রতিদিন গড়ে ১০০ এর উপরে। বিগত ২০২৪ সালে এই হাসপাতালের শয্যা ব্যবহারের হার ছিল ২০৮%। কক্সবাজার জেলায় চকরিয়া উপজেলা হাসপাতাল একশ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। এরপরে এই জেলায় আরেকটা একশ শয্যার হলে তার প্রধান দাবিদার হচ্ছি আমরা। আমরা অফিসিয়ালি ৫০ শয্যার হাসপাতাল কে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার এবং উত্তরে চালিয়াতলি পয়েন্টে আরেকটা বিশ শয্যার হাসপাতাল করার প্রস্তাব পাঠিয়েছি।"
আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আজমল হুদা জানান, বর্তমানে হাসপাতালটিতে অল্প কয়েকজন চিকিৎসক ও সীমিত সংখ্যক নার্স দিয়ে প্রতিদিনের রোগী সেবা দেওয়া হচ্ছে, যা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০ জন রোগী ভর্তি হয়, ফলে রোগীদের স্থান সংকুলান এবং মানসম্মত চিকিৎসা প্রদান দুষ্কর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারি ওয়ার্ড, নবজাতক শিশুদের শিশু ওয়ার্ড এবং সাধারণ রোগীদের ওয়ার্ডে রোগীর চাপ চরমে পৌঁছেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে অনেককেই মেঝেতে শুয়ে থাকতে হচ্ছে। জরুরি অস্ত্রোপচার কিংবা প্রসবকালীন জটিলতায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রামে পাঠাতে বাধ্য হতে হচ্ছে, যা সময় ও খরচের দিক থেকে দ্বীপবাসীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
দ্বীপের বাসিন্দা ও এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন বলেন, “৫০ শয্যার হাসপাতালের জন্য যে পরিমাণ রোগী সে পরিমাণ অবকাঠামো ও সরঞ্জাম প্রয়োজন, মহেশখালীতে তার অভাব রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও পর্যাপ্ত ওষুধের অভাবে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের জন্য অপারেশন থিয়েটারের অভাব গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “অনতিবিলম্বে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ জরুরি।”
উপজেলা জাতীয়তাবাদী যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আসম জাহেদুল হক নাহিদ বলেন, “দ্বীপবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিগত বিএনপি সরকার আধুনিক মানের নতুন ভবন, ডাক্তার পদায়ন, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামসহ অনেক কিছু দিয়েছিলো। কিন্তু সরকারে পরিবর্তনের পর সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেনি ফ্যাসিস্ট সরকার। এক প্রকার অবহেলিত করে রেখেছিলো দ্বীপের স্বাস্থ্য সেবা।"
তিনি আরো বলেন-"স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি, অধিদপ্তর থেকে তদবির করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে আসা ও কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মহেশখালী হাসপাতালের সংকট পুরো দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্যই বড় শিক্ষা হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার, আর সেই অধিকার রক্ষায় সরকারকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সংযোজন, প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ এবং পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত না হলে, মহেশখালী দ্বীপবাসীর জীবন-ঝুঁকি আরও বাড়বে। এনজিওগুলোর সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করা কিংবা স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান বের করা এখন সময়ের দাবি।
আসিফ