ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২

শিক্ষকদের সামনেই শিক্ষার্থীকে পেটালো ছাত্রদল নেতা, প্রতিবাদ না করায় অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশন

রিজভী আহম্মেদ রিজোয়ান, নওগাঁ।

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ২৭ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ২১:০০, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

শিক্ষকদের সামনেই শিক্ষার্থীকে পেটালো ছাত্রদল নেতা, প্রতিবাদ না করায় অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশন

নওগাঁয় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাফিউল ইসলাম রিফাত (২২) নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে। শনিবার (২৬ এপ্রিল) বেলা ১১টার দিকে নওগাঁ সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রক্যাশ্য এই হামলার ঘটনা ঘটে। পরে রোববার (২৭ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টায় কলেজ চত্ত্বরে এই হামলার ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারসহ প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষকদের পদত্যাগ দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ পালনসহ আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছে শিক্ষার্থীরা।


হামলার অভিযোগ উঠা ওই ছাত্রদল নেতার নাম শাহরিয়ার শিশির। জেলা ছাত্রদলের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক পদে রয়েছেন তিনি। অপরদিকে, আহত রিফাত নওগাঁ সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বর্তমানে গুরুত্বর আহত হয়ে ২৫০ শয্যা নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। 


এ কর্মসূচিতে নওগাঁ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জুনায়েদ হোসেন, সাদনান সাকিব, রাজনসহ অন্যান্যরা বক্তব্য রাখেন। 


শিক্ষার্থীরা বলেন, হামলার ঘটনাস্থলে কলেজ অধ্যক্ষ সামসুল হক এবং শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সহযোগী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বিদ্যুৎ উপস্থিত ছিলেন। তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার পরেও কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় কলেজ অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক পরিষদের সম্পাদদের পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ছাত্রদল নেতা সন্ত্রাসী শিশির প্রক্যাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবিলম্বে তাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আইনের আওতায় আনতে হবে।


দুপুর ২টার দিকে কলেজ অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক পরিষদের সম্পাদকের পদত্যাগের দাবিতে একটি মিছিল বের করে নানা স্লোগান দিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি কলেজ অধ্যক্ষের কার্যালয়ের কাছে পৌঁছালে কর্মচারিরা ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে দেয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সেনাবাহিনী এবং থানা পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তবে এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থ্যা না নেওয়ায় অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক পরিষদ সম্পাদকের পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবিতে আমরণ অনশনে বসে শিক্ষার্থীরা। 


প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, গত ২৩ এপ্রিল রাফিউল ইসলাম রিফাত তার ব্যবহৃত ফেইসবুক একাউন্ট থেকে নওগাঁ [Naogaon] নামক একটি গ্রুপে সড়কের উপর নির্মাণাধীন একটি ভবনের পাথর এবং বালি রাখা নিয়ে ১০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পোস্ট করে। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখেন "আমাদের নওগাঁর মানুষের হাঁটার জায়গায় কিভাবে তারা ইট বালু খোয়া ফেলে দিয়ে রাখছে দেখেন কি করতেছে এইটা। এগুলো কি দেখতে পায় না আমাদের নওগাঁ জেলা প্রশাসক। এটা তো মানুষের হাটার জায়গা। এই জায়গায় কেন বালি ফেলে দিয়ে রাখবে"।

পরে শনিবার (২৬ এপ্রিল) বেলা ১১টার দিকে রিফাত কলেজে প্রবেশ করলে আগে থেকেই সেখানে ছাত্রদলের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়ার শিশিরসহ তার অনুসারীরা অবস্থান করছিলেন। এ সময় তারা রিফাতকে ডেকে ভিডিওটির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা রিফাতকে লাঠিসোঠা দিয়ে আঘাত করে আহত করেন। 


এই ঘটনার পর ক্ষোভে ফুঁসে উঠে নওগাঁর ছাত্রসমাজ। 


এ বিষয়ে নওগাঁ সরকারি কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সিয়াম শিথিল বলেন, শিশির ছাত্রদলের রাজনীতিতে কখনোই সক্রিয় ছিলো না। সে সব সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নূর মোহাম্মদ লালের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সে ছাত্রদলের পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় অরাজকতা সৃষ্টি করে বেড়াচ্ছে। এই ঘটনার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে থাকা শিশিরের বেশ কয়েকটি ছবি ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা এই সন্ত্রাসীর গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।


হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নওগাঁয় নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী ফজলে রাব্বি বলেন, শিশির এবং তার ১০ থেকে ১৫ জন পেটুয়া বাহিনী মিলে রিফাতকে বেধড়ক মেরে আহত করেছে। হামলা চলাকালীন সময় কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক শামসুল হক এবং শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মনিরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এরপরেও তারা কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উল্টো তারা শিশিরকে অফিসে ডেকে নিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। 


৩ দফা দাবিতে আমরণ অনশনে বসা হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের  শিক্ষার্থী সাদনান সাকিব বলেন, হামলার ঘটনায় কলেজ অধ্যক্ষ উপস্থিত থাকার পরেও কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা ৩ দফা দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছি। দাবিগুলো কলেজের অধ্যক্ষকে জানিয়েছি। কিন্তু দাবি পূরণের বিষয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে কোন কথা বলেননি। আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন চালিয়ে যাবো। 


এ হামলায় আহত শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম রিফাত বলেন, আমি কলেজে প্রবেশ করলে শিশির ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন "তুমি কি এই পোস্ট করেছো"? আমি বলি "হ্যাঁ" আমি পোস্ট করেছি। এক পর্যায়ে তারা আমাকে বেধড়ক মারধর করে। এতে আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পাই। আমার বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। 


অভিযোগের বিষয়ে জানতে নওগাঁ জেলা ছাত্রদলের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়ার শিশিরের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 


এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মামুন ইসলাম বিন দোহা বলেন, শিশিরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ পাঠানো হবে। 


নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সামসুল হক বলেন, কলেজে কিছু বহিরাগত ঢুকে বিশৃঙ্খলা করেছিলো। ওই সময়ে আমি কলেজে উপস্থিত থাকলেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। আমার পদত্যাগের যে দাবি করা হচ্ছে, আমি তাদেরকে বলবো তারা আমার পদত্যাগের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করুক। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো প্রকার নির্দেশনা না আসা অবধি আমি আমার পদ থেকে সরে দাঁড়াবো না।

রিফাত

×