
বিএডিসি পরিচালিত দেশের একমাত্র আলু জার্মপ্লাজম সেন্টার নীলফামারীর ডোমারে ৮৮ জাতের আলুর বীজ উৎপাদন করেছে
হার্মোসা, প্রিমাভেরা, এভারেস্ট, টুইনার, প্রাডা, কুইন অ্যানি, সানশাইন, সেভেন ফোর সেভেন, কার্ডিনাল, হল্যান্ড, সাইতা, শিলবিলাতি, জলপাইসিল, লালটিয়া, কেশর, ফ্রাই সোনা, উদয়, সিলভানা, মানিক, করন, জামুনি, নীলকণ্ঠসহ আরও কত কি! এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির আলুর নাম।
বাজারে সাধারণত ৪-৫ ধরনের আলু পাওয়া গেলেও নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় অবস্থিত কৃষি খামারে গড়ে উঠেছে ৮৮ জাতের আলুর বীজ সংগ্রহশালা। যাকে বলা হচ্ছে ‘জীবন্ত আলুর জাদুঘর’। এটি পরিচালনা করছে বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন)। এটিকে বিশেষায়িত ভিত্তিবীজ আলু উৎপাদন খামারও বলা হয়ে থাকে।
বর্তমানে বছরে ১ কোটি টনের বেশি উন্নত জাতের আলু উৎপাদন হয়। দেশে আলুর বীজের চাহিদা রয়েছে ৬০-৭০ লাখ টনের মতো। উৎপাদিত আলুতে পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিদেশে এর চাহিদা কম। সেজন্য বিদেশের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রপ্তানি ও শিল্পে ব্যবহারযোগ্য আলুর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সেই লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
সোনারায় কৃষি খামারÑ সারি সারি সাজানো শতাধিক জাতের আলুর সংগ্রহশালা। এটিই দেশের একমাত্র আলু জার্মপ্লাজম সেন্টার। দৃষ্টিনন্দন এই জাদুঘর দর্শনার্থীদের মন ভোলানোর পাশাপাশি অবদান রাখছে বৈদেশিক আয় ও খাদ্য নিরাপত্তায়। আলু নিয়ে গবেষক, কর্মকর্তা আর চাষিদের নতুন নতুন পরিকল্পনা জোগানও দেয় এই জীবন্ত আলুর জাদুঘর।
আলুকে বলা যায় প্রথম মহাকাশ ভ্রমণকারী সবজি। মহাকাশে দীর্ঘ ভ্রমণে যেন মহাকাশযাত্রীদের খাবারের সমস্যা না হয়, সেজন্য পরীক্ষামূলকভাবে ১৯৯৫ সালে ¯েপস শাটল কলম্বিয়া অভিযানে চাষের জন্য আলু মহাকাশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইতিহাসে দেখা যায় ১৮৯৬ সালে প্রায় ১ লাখ স্বর্ণসন্ধানী সোনার খোঁজে কানাডার ক্লোনডাইক অঞ্চলে গিয়েছিলেন। এ ঘটনাকে বলা হয় ক্লোনডাইক গোল্ড রাশ। সে সময় পুষ্টিকর খাবার হিসেবে আলু এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, স্বর্ণসন্ধানীরা আলুর বিনিময়ে সোনা দিতেন।
সেই আলুই এখন বাংলাদেশের নীলফামারীর সোনারায় ইউনিয়নের বিএডিসির বীজ কেন্দ্রে হচ্ছে ৮৮ প্রজাতিতে। আলুর জীবন্ত জাদুঘর দেখতে আসা অনেক দর্শনার্থী বলছেন, আলুর এই জীবন্ত জাদুঘর দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না! এখানে আমরা ৮৮টি জাতের আলু পেয়েছি। এই জাতগুলো যদি কৃষকরা আগামীতে নিজ নিজ জমিতে উৎপাদন করেন তাহলে তাদের মধ্যে উন্নয়নের একটি অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে।
ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের সহায়তার লক্ষ্যে স্থাপিত হয় আলুর এই জীবন্ত জাদুঘর। কর্মকর্তা বলছেন, পুরানো আলুর জাত ফেরানো এবং আলুর নতুন জাত উদ্ভাবনে ভূমিকা রাখবে এটি। খামারের টিস্যু কালচার ল্যাবে গিয়ে দেখা যায়, জার্মপ্লাজম সেন্টারে বাংলাদেশে যে সময় থেকে আলু চাষ শুরু হয়, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো আলুর জাত রয়েছে সকল আলুর বীজ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে! যা বিশ্বের আর কোনো স্থানে তেমনটা নেই। এটি বাংলাদেশের গর্ব।
বিএডিসি’র সহকারী পরিচালক সুব্রত মজুমদার বলেন, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও আলুর যে বৈদেশিক বাণিজ্য দেশের অর্থনীতিতে তা আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সম্প্রতি এই জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন বিএডিসি চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমিন খান। এ সময় তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এখানে সংরক্ষিত আলুর জাত নিয়ে আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই মিলবে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জাতকে আমরা উন্নত করেছি এবং কৃষকদের কাছে এটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। বাকি জাতগুলোকেও কিভাবে উন্নত করা যায় এবং আরও কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি। তিনি জানান, বিএডিসি সম্প্রতি নতুন করে আরও ১৬টি জাত উদ্ভাবন করে বিদেশে আলু রপ্তানির দ্বার উন্মোচন করেছে।
ডোমার ভিত্তিক বীজআলু উৎপাদন খামারের উপপরিচালক (খামার) কৃষিবিদ আবু তালেব মিঞা বলেন, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজবাড়িতে প্রথম নৈনিতাল জাতের আলুর চাষ সম্প্রসারণ করেন। তিনি বলেন, কৃষকরা প্রয়োজনীয় উপযোগী যে জাতগুলো সহজে গ্রহণ করবে সেই জাতগুলোকে নিয়ে আমরা টিস্যু কালচারের মাধ্যমে নতুনভাবে পিউরিফাই করে একেবারে রোগমুক্ত করে আবার এটাকে বীজ বর্ধন করে কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করি। সেক্ষেত্রে জার্মপ্লাজমটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এই কৃষিবিদ আরও জানান, নীলফামারী অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া আলু আবাদের জন্য উপযোগী। বর্তমানে দ-ায়মান ফসলের সার্বিক অবস্থা খুবই ভালো পর্যায়ে রয়েছে, যা থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গুণগত মানস¤পন্ন বীজআলু উৎপাদন করা সম্ভব হবে। উৎপাদিত বীজআলু দেশের চাষিদের আলু উৎপাদনে বীজআলু সরবরাহের ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিএডিসি কর্তৃপক্ষ সরকার নির্ধারিত মূল্যে এ গ্রেড (২৫-৪০ মিমি) এবং বি গ্রেড (৪১-৫৫ মিমি) সাইজের বীজআলু সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করবে যা পরবর্তী সময়ে মৌসুমে বীজ ডিলারের মাধ্যমে সাধারণ আলুচাষিদের কাছে ন্যায্যমূল্যে বীজআলু সরবরাহ করা হবে।
উল্লেখ্য. নীলফামারী বীজআলু উৎপাদন জোন ভৌগোলিকভাবে এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেখানে বীজআলু উৎপাদনের উপযুক্ত আবহাওয়া বিদ্যমান। নীলফামারী বীজআলু উৎপাদন জোন এরই মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যে একটি সম্ভাবনাময় জোন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় এই এলাকায় শিক্ষিত বেকার যুবকদের বীজআলু উৎপাদনে নিয়োজিত করা হয়েছে। এতে করে এ এলাকার মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।