ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

১৯৪৭-এর পর ভারতীয় উপমহাদেশের দেশীয় রাজ্যগুলোর ভাগ্য: শক্তির খেলায় ইতিহাস বদল

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ২৬ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ২১:৪৭, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

১৯৪৭-এর পর ভারতীয় উপমহাদেশের দেশীয় রাজ্যগুলোর ভাগ্য: শক্তির খেলায় ইতিহাস বদল

ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।তবে ব্রিটিশ শাসনাধীন সরাসরি অংশ ছাড়া, উপমহাদেশে তখনও প্রায় ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্য বা স্বশাসিত রাজ্য ছিল, যাদের নিজস্ব রাজা, নবাব বা জমিদার ছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আইন (Indian Independence Act, 1947) অনুসারে, এই রাজ্যগুলোর উপর সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা ছিল—তারা চাইলে ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারত, আবার চাইলে স্বাধীনও থাকতে পারত।

এই রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, মনিপুর, ত্রিপুরা, ও বেলুচিস্তান। এদের অধিকাংশই প্রথমে স্বাধীন থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু দ্রুতই বাস্তবতার কঠিন মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাদের।

পাকিস্তানের দুর্বলতা ও ভারতের সক্রিয়তা

পাকিস্তান সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে অনেক দিক থেকে দুর্বল ছিল—প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল, সেনাবাহিনী গোছানো ছিল না, অর্থনৈতিক অবস্থাও ছিল সংকটাপন্ন। ফলে পাকিস্তান বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্যের সাথে সময়মতো কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। কেবল সীমান্তবর্তী কাশ্মীর, জুনাগড়, ও বেলুচিস্তান অঞ্চলের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়। অন্যদিকে, ভারতের নেতৃত্বে থাকা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং ভি পি মেনন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে একটি সুপরিকল্পিত অভিযান পরিচালনা করেন—"Integration of Princely States"।

কূটনৈতিক চাপ, জনমতের দাবি, কখনও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ভারত প্রায় ৫০০টি দেশীয় রাজ্যকে একীভূত করে। ১৯৪৮ সালে "অপারেশন পলো" নামক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারতের সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদ দখল করে। একইভাবে, জুনাগড়ে পাকিস্তানপন্থী নবাব যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, ভারত গণভোটের মাধ্যমে রাজ্যটিকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে।

কাশ্মীর প্রশ্ন: এক অনন্ত দ্বন্দ্বের সূচনা

কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং স্বাধীন থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানপন্থী উপজাতি হামলার মুখে তিনি ভারতের সাথে "Instrument of Accession" স্বাক্ষর করে ভারতের সাহায্য চান। এরপর থেকেই কাশ্মীর বিভক্ত হয়ে যায়—ভারতের নিয়ন্ত্রণে জম্মু ও কাশ্মীর, পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান। কাশ্মীর সমস্যা আজও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সবচেয়ে বড় জটিলতা হিসেবে রয়ে গেছে।

বেলুচিস্তান: স্বাধীনতার স্বপ্ন ভাঙা

বেলুচিস্তানের খান অফ কালাত প্রথমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু কিছু মাসের মধ্যেই পাকিস্তান চাপের মাধ্যমে বেলুচিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করে, যার ফলে আজও সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলমান।

১৯৪৭ সালের পরের ইতিহাস দেখায়, শুধু নীতি বা জনগণের ইচ্ছা নয়, শক্তি ও সংগঠিত নেতৃত্বের ভূমিকাই অধিকাংশ দেশীয় রাজ্যের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। পাকিস্তানের দুর্বলতা ও ভারতের শক্তিশালী কৌশল দেশীয় রাজ্যগুলোর মানচিত্র বদলে দেয়। আজও এই অসমাপ্ত ইতিহাস ভারত-পাকিস্তান, এমনকি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে গভীর ছায়া ফেলছে। 

আসিফ

×