ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

অদৃশ্য শক্তির বাঁধা? আট বছর ধরে সুপ্রিমকোর্টে ঝুলে আছে সাত খুনের আপিল

মো. খলিলুর রহমান, স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৮:২৯, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

অদৃশ্য শক্তির বাঁধা? আট বছর ধরে সুপ্রিমকোর্টে ঝুলে আছে সাত খুনের আপিল

ছবি: সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে বহুল আলোচিত সাত খুন মামলাটি সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে শুনানীর জন্য দীর্ঘ আট বছর ধরে ঝুলে আছে। নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ কোন এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে মামলাটি শুনানি হচ্ছে না। যেই কারণে নিম্ন আদালতে ও উচ্চ আদালতে বিচার সম্পন্ন হওয়ার পরও আসামিদের রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। নিম্ন আদালতে রায়ের পর উচ্চ আদালতে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ও ১১ জনকে যাবজ্জীবন ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। দীর্ঘ ১১ বছরেও বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন নিহতদের স্বজনরা। তাঁদের দাবি সরকারের কাছে আমাদের আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু  জীবদ্দশায় সাত খুনের আসামিদের বিচার শেষে রায় কার্যকর দেখে যেতে চাই।

রবিবার ২৭ এপ্রিল আলোচিত এ সাত খুন মামলাটি ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে। দ্রুত এ রায় কার্যকর করার দাবিতে নিহতের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী শুক্রবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন পালন করেছেন।

জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্করোডের লামাপাড়া এলাকায় র‌্যাব-১১ তৎকালীন সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদের নির্দেশে কথিত চেকপোস্ট বসিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাচঁজনকে এবং ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালকসহ মোট সাতজনকে অপহরণ করে র‌্যাব সদস্যরা। ওই দিনই সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনায় ফেলে দেয়। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে নজরুল ইসলামসহ ৬ জন ও পরদিন ১ মে একজনের লাশ ভেসে উঠলে পুলিশ একে একে সাতটি লাশই উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে পুরো নারায়ণগঞ্জসহ সমগ্র বাংলাদেশ। পরবর্তীতে র‌্যাব-১১’র লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন, লে কমান্ডার এম এম রানাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় মামলার প্রধান মাস্টারমাইন্ড নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিল নুর হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট আসামিদের। দীর্ঘ ১১ বছরে বিচার কার্য শেষ না হওয়ায় এখন রাস্তায় নামতে হয়েছেন স্বজনরা। শুক্রবার দুপুরে আলোচিত সাতখুনের মামলাটি দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে রায় কার্যকর করার দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকায় মানববন্ধন করেছেন নিহতদের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী। 

নিহত প্যানের মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, কোন এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় দীর্ঘ আট বছর ধরে সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি শুনানীর জন্য ঝুলে আছে। কেন এই বিচার ঝুলে আছে আমরা তা রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাই। আমাদের দাবি আইন ও বিচার বিভাগের প্রতি ও আইন উপদেষ্টার প্রতি, এই সাতটি পরিবারের দিকে তাকিয়ে এই রায় দ্রুত কার্যকর করুন। তিনি বলেন, সাত খুনের রায় কার্যকর না হওয়া আমরা অনিশ্চয়তায় ভুগছি। ১১ বছর অনেক মামলারই রায় কার্যকর হয়েছে। সাত খুনের মামলাটি একটি আলোচিত মামলা। এ খুনের বিষয়টি সবাই জানেন, সকল কিছুই প্রমাণিত, সব কিছুই চোখের দেখা। কেন এ মামলাটি এখনও ঝুলে থাকবে? তাহলে বাংলাদেশের আইনের প্রতি কীভাবে আমাদের শ্রদ্ধা থাকবে। আমরাতো আইনের প্রতি আস্থাশীল। এ মামলাটির রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক। এই সাতটি পরিবার এ হত্যাকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে গেছে। নিহতদের পরিবার অন্তত এইটুকু নিয়ে স্বস্তিতে থাকুক, তারা এ হত্যাকাণ্ডটির বিচার পেয়েছে। তারা নির্মমভাবে সাতজনকে হত্যা করেছে। সাতটি পরিবারে যারা মারা গেছেন তারাতো অনেক কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন। তাদের এ হত্যার বিচার যদি দ্রুত না হয় তবে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি? আমরা চাই যাতে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আলোচিত এ সাত খুনের মামলাটির দিকে একটু দৃষ্টি দেন। প্রধান উপদেষ্টা যদি সহযোগিতা করেন তবে আশা করি মামলাটি দ্রুত এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আইনসচিব ও আইন উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ মামলাটি প্রতি যেন সু-দৃষ্টি দেন এবং সার্বিক সহযোগিতা করেন তাহলেই মামলাটির রায় দ্রুত কার্যকর হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। যাদেরকে হারিয়েছি তাদেরতো আর কোন দিনই ফিরে পাব না। এই হত্যাকাণ্ডের যেন সুষ্ঠু বিচার হয় এই আশায় এখন আমরা প্রহর গুনছি। নিহত গাড়ি চালক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী সামছুন নাহার নুপুর বলেন, জাহাঙ্গীর নিহত হওয়ার সময় আমার সন্তান রোজা ছিল গর্বে। আজ রোজার ১১ বছর চলছে। কিন্তু এখনো আমরা বিচার পাইনি। আমার মেয়ে বাবার আদার সোহাগ বঞ্চিত হয়েছে। আমি সরকারের কাছে দাবি করছি, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যাতে দ্রুত শেষ করে আসামিদের রায় কার্যকর করেন।

নিহত তাজুল ইসলামের ছোট ভাই রাজু আহমেদ বলেন, কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আমার বড় ভাই তাজুল ইসলামসহ নিরীহ সাতজন মানুষকে নূর হোসেনের অবৈধ টাকা কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে র‌্যাব-১১’র সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, কমান্ডার এম এম রানাসহ অন্যান্যরা অপহরণ ও নির্মমভাবে খুন করে। এ হত্যাকাণ্ডের আজ ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে। একটি মামলার সব কিছুই প্রমাণ হওয়ার পর ও হাইকোর্টের রায় হওয়ার পরও কোন অপশক্তি ও অদৃশ্য ছায়ার কারণে এতোদিন আপিল বিভাগে মামলাটি ঝুলে আছে। আমি রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতে মামলার সবকিছু প্রমাণিত হওয়ার পর ও আসামীরা জেলে থাকার পরও আসামিদের ফাঁসির রায় কেন কার্যকর হচ্ছে না। নিহত তাজুল ইসলামের পিতা আবুল খায়ের বলেন, বিগত ১১টি বছর অপেক্ষা করতে করতে আজ আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এখন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, মাননীয় আইন উপদেষ্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রধান বিচারপতির কাছে আমাদের আকুল আবেদন এ অপেক্ষার পালা থেকে রেহাই দেয়ার চেষ্টা করেন। সাত খুনে যে রায় হয়েছে সেই রায়টি দ্রুত কার্যকর করে আমাদেরকে একটু সান্ত্বনার বাণী শুনান। আমরা যাতে একটু সান্ত্বনা পাই।

সাত খুন মামলার নিম্ন আদালতের বাদি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, শুরু থেকেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মামলাটি নিয়ে নানা তালবাহানা করতে থাকে। কিন্তু জনগণের চাপের কারণে নি¤œ ও উচ্চ আদালতে সাত খুনের মামলাটি দ্রুত বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু আসামীপক্ষ  সুপ্রিমকোর্টে আপিল করার পর সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রভাবের কারণে শুনানি হয়নি। যাতে আগামী পক্ষ সুবিধা পায়। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এই মামলাটির দ্রুত শুনানি সম্পন্ন করে রায় কার্যকর করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানাই। যাতে অপরাধীরা বুঝতে পারে অপরাধী যত বড় প্রভাবশালী হোক না কেন, অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে।
উল্লেখ্য, আলোচিত এ সাত খুনের মামলাটি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি ৩৫ আসামির মধ্যে সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, অব্যাহতিপ্রাপ্ত র‌্যাব-১১ সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, কমান্ডার এম এম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। উচ্চ আদালতে আসামি পক্ষ আপিল করলে ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক ৩ কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল ও ১১ জনকে যাবজ্জীবন ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।

আরো উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার, নিহত নজরুল ইসলামের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামানের গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর আলম ও আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি চালক ইব্রাহিমসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল নজরুল ইসলামসহ ৬ জন ও পরদিন ১ মে সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন।

ফারুক

×