
ছবি সংগৃহীত
জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর গারো পাহাড় ফের প্রাকৃতিক বনে পরিণত হচ্ছে। স্থানীয়দের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একসময় প্রাকৃতিক বন উজাড় করে গারো পাহাড়ে সৃজন করা হয়েছিল বিদেশি জাতের আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস গাছের উডলট বাগান। এসব বাগান সৃজনের ফলে পাহাড়ের ঝিরি বা ঝর্ণাধারা বন্ধ হয়ে যায়। এতে হুমকির মুখে পড়ে জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য।
তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার কথা বিবেচনা করে ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন পাহাড়ি বনে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির গাছ দিয়ে সৃজন করা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি মিশ্র বন বাগান।
বর্তমানে সবুজে ছেঁয়ে গেছে গারো পাহাড়। জেলার পর্যটন এলাকা হিসেবে এখানে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশ অবলোকন করতে দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুসহ অনেক পর্যটক ছুটে আসছেন এখন গারো পাহাড়ে। প্রাকৃতিক বন সৃজন করায় একদিকে যেমন জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হবে গারো পাহাড়। এতে পর্যটন খাত থেকে সরকার আরও বেশি রাজস্ব আয় করতে পারবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় অধিবাসীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে প্রাকৃতিক বন কেটে সৃজন করা হয় সামাজিক বন। এতে আকাশমনি, মিনজুরি ও ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর ফলে গারো পাহাড়ের জলবায়ু ও বন্যপ্রাণী-পাখিসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে। বিলুপ্ত হতে থাকে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা বনজ গাছপালা। ২০০০ সাল থেকে পাহাড়ে পর্যাপ্ত খাদ্য না পেয়ে বন্য হাতির দল লোকালয়ে তাণ্ডব চালাতে থাকে।
এরপর থেকে বন বিভাগ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এসব পাহাড়ে পর্যায়ক্রমে বিলুপ্তপ্রায় গর্জন, ছাতিয়ান, হরিতকি, বহেরা, সোনালু, পলাশ, জারুল, ঢেউয়া, কাঞ্চন, জলপাই, শাল, পিতরাজ, অর্জুন, অশোক, আমলকি, আগর, কদম, কাঠবাদাম, কৃষ্ণচূড়া, করচ, কামরাঙা, গোলাপজাম, গাব, গামার, চিকরাশি, চালতা, চাম্পা, চাপালিশ, জাম, জাম্বুরা, জগডুমুর, ঢাকিজাম, তেঁতুল, তেলসুর, বড়ই, তুন, দেবদারু, নিম, নাগেশ্বর, পানিয়াল, বাজনা, বকুল, মহুয়া, রক্তচন্দন, রাবার, লোহাকাঠ, শিলকড়ই, শিমুল, শিরীষ ও হলুদ গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়াও এসব বনভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির পাহাড়ি গাছও বেড়ে উঠছে।
সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জের বাতকুচি, সন্ধ্যাকুড়া ও সমশ্চুড়া বনবিটে মোট বনভূমি রয়েছে ৪ হাজার ২৩৫.২৮ একর। এরমধ্যে বিভিন্ন অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৩৪৫ হেক্টর বনভূমিতে দীর্ঘমেয়াদি মিশ্র বাগান সৃজন করা হয়েছে। ফলে গারো পাহাড় এখন প্রাকৃতিক বনে পরিণত হতে চলেছে। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরে আসতে শুরু করেছে। এ বন সৃজন করা হলে আগের মতো গারো পাহাড়ে বাঘ, ভালুক, শূকর, হাতি, হরিণ, বনমোরগ ও শিয়াল-শকুনসহ বিভিন্ন জাতের বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য তৈরি হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তাছাড়া, বর্তমানে গারো পাহাড় এলাকায় বন্য হাতি ও মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব নিরসনে এই প্রাকৃতিক বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ওই প্রাকৃতিক বনের ভেতরে ফলজাত গাছের খাদ্য খেতে পেরে বন্য হাতির পাল আর লোকালয়ে তাণ্ডব চালাবে না। ফলে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমে আসবে। পাশাপাশি প্রতিদিন গারো পাহাড় এলাকায় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য ও বন্যপ্রাণী দেখতে ছুটে আসবেন।
তাই এখানে পর্যটকদের জন্য সরকারিভাবে হোটেল-মোটেল গড়ে তুলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করা সম্ভব।
বন বিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা দেওয়ান আলী বলেন, “বনজ সম্পদ বৃদ্ধি ও পরিবেশ রক্ষায় গারো পাহাড়ের মধুটিলা রেঞ্জে ইতোমধ্যে বেতবাগানসহ ৪০০ হেক্টর বনভূমিতে মিশ্র বাগান সৃজন করা হয়েছে। এই এলাকায় পর্যায়ক্রমে আরও দীর্ঘমেয়াদি মিশ্র বাগান সৃজন করা হবে।”
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ.ন.ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, “সৃজিত এসব মিশ্র বাগানে বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রজাতির বিভিন্ন গাছপালা ও ঔষধি গাছসহ প্রায় ৫০-৬০ প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। এতে গারো পাহাড় ধীরে ধীরে আগের মতো প্রাকৃতিক বনে পরিণত হবে। বিলুপ্তপ্রায় এসব প্রজাতির আধিক্যের কারণে গবেষণা ও শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপকভাবে কাজে লাগবে এই মিশ্র বন। তাই গারো পাহাড় এলাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে মিশ্র বাগান সৃজন করা হচ্ছে। ওইসব বনে নতুন করে লতাগুল্ম সৃষ্টি হওয়ার ফলে বন্য হাতির খাদ্য সংকট দূর হবে। এতে ক্ষুধার্ত হাতির দল আর লোকালয়ে তাণ্ডব চালাবে না। এতে ভুক্তভোগীদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমে আসবে। পাশাপাশি গারো পাহাড় থেকে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ আহরণসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষা পাবে।”
আশিক