
আবদুল জব্বারের বলীখেলার ফাইনালে লড়ছেন বাঘা শরীফ ও রাশেদ বলী। ইনসেটে চ্যাম্পিয়ন শরীফ
গেল বছর প্রথমবারের মতো আসরে নেমেই করেছিলেন বাজিমাত। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলার ১১৬তম আসরেও চ্যাম্পিয়ন তিনি। কুমিল্লার মো. শরীফ ওরফে বাঘা শরীফের মাথায় ফের উঠেছে বিজয়ের মুকুট। রানারআপ হয়েছেন কুমিল্লারই রাশেদ বলী। তিনিও তাঁর আগের অবস্থান অক্ষুণœ রেখেছেন।
আবদুল জব্বারের বলীখেলার ১১৬তম আসর ছিল ২৫ এপ্রিল শুক্রবার। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার শুরু হয় ৩ দিনব্যাপী দেশের বৃহত্তম বৈশাখী মেলা, যা শেষ হচ্ছে আজ শনিবার। দ্বিতীয় দিনের বিকেলটাতে বলীখেলার আমেজ। এটিই মূল আকর্ষণ। হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে এই মহারণ উপভোগ করতে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেকটাই হারিয়ে যাওয়া বলীখেলা প্রত্যক্ষ করার আনন্দই আলাদা।
আবদুল জব্বারের বলীখেলার পরিচিতি ও আকর্ষণ দেশব্যাপী। এই খেলায় অংশ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন বলীরা। বিভিন্ন জেলা থেকে এবার চট্টগ্রামে আসা মোট ১২০ জন বলী নিবন্ধন করেন। এরমধ্যে বাছাই করে ৮০ জন প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত হন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক বলী কলিম উল্লাহ (৬৬)। আর কনিষ্ঠ বলী কিশোর ফয়সাল। শুক্রবার বিকেল ৪টায় শুরু হয় বলীখেলা।
জোড়ায় জোড়ায় উঠতে থাকেন সুঠাম দেহের অধিকারী বলীরা। এর আগেই বলীখেলার রিং ঘিরে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। ব্যাপক আগ্রহ সকলের চোখেমুখে। চলছিল ঢাক-ঢোলের শব্দ ও সুরের মূর্ছনা। প্রথম রাউন্ডের পর্ব শেষ হয় মোটামুটি অল্প সময়ের মধ্যেই। মানে বলীরা উঠছেন আর ধরাশায়ী হয়ে একে একে বিদায় নিচ্ছেন।
বলীখেলায় প্রয়োজন পেশীশক্তি ও বাহুবল। তবে শুধুমাত্র শক্তি দিয়েই হয় না, জানতে হয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল। যতই শক্তি থাকুক না কেন, প্রতিপক্ষের পিঠ ঠেকাতে হবে মাটিতে। সে কারণে একজনের পিঠ ঠেকানোর এবং অপরজনের পিঠ রক্ষার চেষ্টা। বৈশাখের প্রখর রোদের মধ্যে দাঁড়িয়েও হাজারো মানুষের প্রতীক্ষা, কে হচ্ছেন এবারের চ্যাম্পিয়ন।
জব্বারের বলীখেলার ১১৬তম আসরে এবার প্রথম রাউন্ডে অংশ নেন ৮০ জন বলী। এখান থেকে ৪ জন এবং আগের বছরের ৪ জন নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ৮ জনের চ্যালেঞ্জ রাউন্ড। নিয়ম অনুযায়ী পূর্ববর্তী বছরের শীর্ষ চার বলী সরাসরি চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
আকর্ষণীয় চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে চট্টগ্রামের কাঞ্চনকে হারিয়ে কুমিল্লার কামাল, কুমিল্লার দিপুকে হারিয়ে বাঘা শরীফ, সীতাকু-ের রাসেলকে হারিয়ে ১১৪তম আসরের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল এবং রাঙ্গামাটির রুবেলকে হারিয়ে কুমিল্লার রাশেদ বলী নিশ্চিত করেন সেমিফাইনাল।
সেমিফাইনালে বাঘা শরীফ পরাজিত করেন নিজ জেলার কামালকে। অপরদিকে গত আসরের রানারআপ রাশেদ বলী পরাজিত করেন এর আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল বলীকে। ফাইনালে ওঠেন বাঘা শরীফ ও রাশেদ বলী। এ দুইজনের মধ্যে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে খেলা হওয়ার পর প্রধান রেফারি হাফিজুর রহমান রাশেদ বলীকে ‘টেকনিক্যাল আউট’ ঘোষণা করেন। হাত উঁচিয়ে বাঘা শরীফকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেন রেফারি। দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়ে নৃত্য ও আনন্দদায়ক অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়ে তিনি অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।
চ্যাম্পিয়ন বলীর হাতে প্রাইজমানি ও শিরোপা তুলে দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, আবদুল জব্বার সওদাগরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল এবং বলীখেলা আয়োজক কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এবারও বলীখেলা স্পন্সর করে গ্রামীণফোন।
উল্লেখ্য, বিপ্লবতীর্থ হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামে এই বলীখেলার যাত্রা শুরু হয় ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ। চট্টগ্রাম নগরীর বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই বলীখেলার সূচনা করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ ও শারীরিকভাবে শক্ত সমর্থ করার লক্ষ্যে তিনি নিয়মিতভাবে এই ধরনের একটি বলীখেলা আয়োজনের চিন্তা করেন। মাঠে গড়াবার পর থেকে প্রতিবছর চলতে চলতে এটি রূপ নেয় চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যে।
চট্টগ্রামে আবদুল জব্বারের বলীখেলার পরিচিতি এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই বলীখেলার অনুকরণে অনেক জেলাতেই ছোট-বড় বলীখেলার আয়োজন হয়ে আসছে। দেশের ইতিহাসে এমন আয়োজন খুব কমই আছে, যা শত বছর পেরিয়েও জনপ্রিয়তা এবং আবেগ ধরে রেখে চলছে। তাই অনেকেরই অভিমত, বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে আবদুল জব্বারের বলীখেলা হতে পারে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত। একটুখানি উদ্যোগ নিলেই তা সম্ভব, এমনই মনে করছেন শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।