
শরীরে ঝরছে ঘাম। বৈশাখের বেশ কিছুদিন বৃস্টির দেখা মিললেও সেই বৃস্টিও হারিয়ে গেছে। সূর্যের দাপট যেন বেড়েই চলেছে। ফলে খরতাপে পুড়ছে উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের আট জেলার মাঠঘাট প্রান্তর। গ্রাম থেকে জেলা উপজেলা শহরের সর্বত্র হাঁসফাঁস অবস্থা। অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন। তীব্র গরমে শ্রমজীবী মানুষ সব থেকে বেশি কাহিল। রিকশা-ভ্যান চালক, দিনমজুর থেকে শুরু করে দিন আনা দিন খাওয়া প্রতিটি মানুষের জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। স্বস্তিতে নেই সাধারণ ব্যবসায়ীরাও। তীব্র গরমে কারণে দিনের বেলা বিপণী বিতানগুলোতে ক্রেতার দেখা মিলছে কম। খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। বাজারে বেড়েছে সবজির দাম। বোরো ধান উঠতে দেরী থাকলেও ভুট্টা আর মরিচ কাটায় ব্যস্ত কৃষকের অবস্থা খুবই নাজুক। গরমের কারনে সমতলের চা বাগানগুলো পুড়ছে। এদিকে তীব্র গরমের কারণে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী. পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর ঠাকারগাঁও, গাইবান্ধা জেলা উপজেলা, গ্রাম,পাড়া মহল্লায় গাছের নিচে ছায়ায় আড্ডা বেড়েছে শীতল ছোঁয়ার আশায়। সব থেকে বেশী শোরগোল তিস্তা সেচ ক্যানেলে । সেখানে ঠান্ডার পরশ পেতে নেমে পড়ছে মানুষজন।
গত তিন দিন ধরে চলছে এ অবস্থা। আবহাওয়া অফিস বলছে শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) চেয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) তাপদাহ বেশী ছিল। তারপরেও গরমভাব বেড়েছে। আগামী দুএকদিনের মধ্যে এর থেকে পরিত্রাণের কোনো সম্ভাবনা দেখছে না স্থানীয় আবহাওয়া অফিস।
নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিন মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে। এর মধ্যে দুদিন তাপমাত্রার দিকে তাকালে দেখা যায় শুক্রবার এ অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা বিরাজ করছিল সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়ার ও সর্বনিম্ন ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে দেখা যায় সর্বোচ্চ ও সর্ব নিম্ন তাপমাত্রার ফারাক মাত্র ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ধারনা করা হচেছ তাপমাত্রার ফারাক আরও কমে আসবে। এতে গরম পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলতে পারে।
নীলফামারীর রিকশাচালক আমিনার রহমান বলেন, গরমে ভাড়াও কমে গেছে। রোদে যেন আগুনের ফুলকি। লোকজন রাস্তায় বের হচ্ছে কম। গরমে শরীরে ঘেমে যাচ্ছে- টপটপ করে ঘাম ঝড়ছে। বড় বাজার এলাকার সবজি বিক্রেতা হায়দার বলেন, রোদের যে তেঁজ গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। বাজারে বসে থাকাও যায় না। বেচা বিক্রিও কম। খরিদ্দাররা সাত সকালের দিকে এসে সামান্য কেনাকাটা করে চলে যাচ্ছে। তার ওপর বাজারে সবজি কম, দামও বেশি। নীলফামারীর তিস্তাপাড়ের চর এলাকায় এবার ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। আগামজাতের ভুট্টা উঠতে শুরু করেছে। নদীর চরের বালুর গরম আরও মারাত্বক। চরখড়িবাড়ি এলাকার ভুট্টচাষী জানালেন ছাতা নিয়ে কাজ করা যায় না। মাথায় পানি দিয়ে গামছা পেচিয়ে ভুট্টা তুলতে হচ্ছে। ডোমার উপজেলায় মরিচ চাষী সেকেন্দার মিয়া বলছেন মরিচ তুলতে রোদের তাপে থাকা যায়না। শ্রমিকরা মজুরি বেশী চাইছে। তারপরেও রোদের তেজে বেশীক্ষন তারা মরিচ তুলতে পারছেনা।
এ ছাড়া উত্তরবঙ্গকে সমতলের চা বলয় বলা হয়ে থাকে। পঞ্চগড়,নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ১০টি ও অনিবন্ধিত ২০টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ ছাড়া ২ হাজার ১৭৪টি নিবন্ধিত ও ৬ হাজার ১৯৭টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তনের চা-বাগান (২৫ একরের কম) আছে। ২০২৩ সালে উত্তরাঞ্চলে ১২ হাজার ১৩২ দশমিক ১৮ একর জমিতে চা চাষ হলেও এবার কিছুটা কমেছে। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে ১১ হাজার ৫২৬ দশমিক ৮৭ একর জমিতে চা
চাষ হচ্ছে। চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আরিফ খান জানান, এবার মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে অতিরিক্ত খরা থাকায় কাঁচা পাতা উৎপাদনে কিছুটা বাধা সৃষ্টি করেছে। বেশ কয়েকদিনে বৃষ্টি চা বাগানকে সতেজ করে তুললেও গত তিনদিন ধরে ফের শুরু হয়েছে তাপদাহ। ফলে কচিপাতা ফুটতে পারছেনা।
তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে চা গাছে স্বাস্থ্যে তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে এছাড়া অতিরিক্ত তাপমাত্রার জন্য চা বাগানে পোকামাকড়ের ব্যাপক উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এতে চা উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে বর্তমানে চা উৎপাদন কমছে বলে দাবি বাগান মালিকগন। এভাবেই গরমের দাপট অব্যাহত থাকলে মুখ থুবড়ে পড়বে চা শিল্প। তীব্র দাবদাহের জন্য শ্রমিকদের চা বাগানে কাজ করতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। প্রভাবশালী চা বাগানের মালিকরা যন্ত্র বসিয়ে সেচ দিতে পারলেও ক্ষুদ্র চাষিরা পড়েছে বিপাকে। তারা সেচযন্ত্র ভাড়া করে সেচ দিচ্ছে। শ্রমিকরা হাতে ছাতা নিয়ে মাথায় টপর দিয়ে চা পাতা উত্তোলন করছে।
এদিকে শহরগুলো লেবুর শরবত বিক্রি বেড়েছে। দোকানীরা শরবত দিয়ে কুলনিকারা পাচ্ছেনা। বিশেষ করে তরমুজ বেল বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। এতে দেখা যাচ্ছে গরমে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে ভাজাপোড়া বিক্রি একেবারে কমে গেছে। তবে বেড়েছে লাচ্ছি আর ফালুদার চাহিদা। ডাবের চাহিদাও বেড়ে যাওয়ায় দাম আকাশচুম্বি হয়েছে। এক একটি ছোট ডাব বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়।
তীব্র গরম পরিস্থিতিতে সবাইকে বাইরে চলাচলে ও খাদ্যাভ্যাসে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েন নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আব্দুল রহীম। তিনি বলেন, বাইরে সাবধানতার সঙ্গে চলাচলের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে। তা না হলে পানি শূন্যতা থেকে জন্ডিস, ডায়রিয়াসহ নানা সমস্যার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে এই তীব্র গরমে। তিনি বলেন, গরমের তীব্রতায় বিশেষ কিছু সতর্কতা মেনে চলা জরুরি। পানি শূন্যতা থেকে রেহাই পেতে ঘন ঘন পানি খেতে হবে। ডায়রিয়া ও জন্ডিস থেকে রক্ষা পেতে ভাজাপোড়াসহ তেল জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
রাজু