
নীলফামারী : ডিমলা ও কুড়িগ্রামের রাজারহাট এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধে কাজ করা হচ্ছে
বর্ষা মৌসমের আগেই তিস্তা নদীর ভাঙনপ্রবণ এলাকায় কাজ শুরু হয়েছে। গত দুইদিনে সরেজমিনে দেখা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে ৪৫ কিলোমিটারের মধ্যে জরুরিভাবে ২০ কিলোমিটার এলাকায় জিও ব্যাগে বালু ভরে এ কাজ শুরু করা হয়। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট এলাকায় কাজের মান ভালো হলেও নীলফামারী, ডিমলা এলাকায় চলছে নয়ছয় অবস্থা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখে রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা নদীর বিষয়ে বিশেষ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সরকারের পানিস¤পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লিী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। আগামী সপ্তাহেই টেন্ডার হবে। তার প্রতিশ্রুতি কাজের টেন্ডারে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই স¤পন্ন হয়। এবং কাজ শুরু হয়েছে। এ জন্য কয়েকটি ভাগে ২০ কোটি টাকার বেশ কিছু ঠিকাদার এ কাজ করছেন।
নীলফামারী ॥ এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানায়, নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তা নদীর তীর রক্ষায় জিও ব্যাগ ফেলার কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। জিও ব্যাগে বালু ভরাট করতে নদীর ভাঙন ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নিষিদ্ধ মেশিন বসিয়ে বালু তুলছে পাউবোর ঠিকাদার। বালু তোলার কারণে পাড়ের ফসলি জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজসহ আশপাশের গ্রামের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, বাঁধসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভাঙন এলাকায় বালু উত্তোলন করা হলেও তা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই পাউবো ও স্থানীয় প্রশাসনের। অবৈধভাবে বালু তোলায় জলে যাবে সরকারের কোটি কোটি টাকার এ প্রকল্প।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তিস্তা নদীর তীর রক্ষায় ২০ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানি ইউনিয়নের বাইশপুকুর এলাকায় ১০৭০ মিটার তীরে জিও ব্যাগ ফেলার প্রকল্প চলমান। এতে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। চারটি প্যাকেজে ভাগ করে ঠিকাদার নিয়োগ করে পাউবো। তবে কাজ স¤পন্ন করছে সাবঠিকাদার। ঝুনাগাছ চাপানির ভেণ্ডাবাড়ী ও সোনাখুলি ¯পার বাঁধ রক্ষায় ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগ ফেলছে ডালিয়া পাউবো। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব ¯পার বাঁধ রক্ষায় দুটি প্রকল্পে সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগ ফেলা হয়। জিও ব্যাগ ভরাট করা হয়েছিল বাঁধের নিচের বালু তুলে। তবে বছর না ঘুরতেই জিও ব্যাগ ধসে পড়ে নদীতে বিলীন হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ বাইশপুকুর, ভেণ্ডাবাড়ী ও সোনাখুলি ¯পার বাঁধের নিচে ভাঙন এলাকা থেকে বালু তুলে ভরা হচ্ছে ব্যাগ। বাঁধ থেকে ৩০ মিটার দূরত্বে নদীর ভাঙন ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে উচ্চ ক্ষমতাস¤পন্ন পাঁচটি বোমা মেশিনে ১০ ইঞ্চি পাইপ যুক্ত করে বালু তোলা হচ্ছে। যদিও এমন মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমনকি নদীর তীর ভাঙনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বালু তোলা নিষেধ। তবে এরপরও উত্তোলন করা পলিমিশ্রিত চিকন বালু দিয়ে পাশেই ভরা হচ্ছে জিও ব্যাগ। অথচ শুষ্ক ও মোটা বালু দিয়ে জিও ব্যাগ ভরাটের নিয়ম রয়েছে।
কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কাজের ঠিকাদারদের অধীনে প্রায় আট দিন ধরে বালু তোলার কাজ করছেন। আর স্থানীয়দের অভিযোগ, ঠিকাদার অধিক মুনাফার লোভে কোনো আইন না মেনে নদীর ভাঙন যেখানে বেশি, সেখান থেকেই বালু উত্তোলন করছে। এই প্রতিরোধব্যবস্থা শুধু পানিতে টাকা ফেলা। একই এলাকার জমির উদ্দিন অভিযোগ করেন, বানের জলে এসব বালুর বস্তা নদীর গভীরে চলে যায়। আর একই প্রক্রিয়ায় বছরের পর বছর কাজ হচ্ছে।
এ বিষয়ে নীলফামারীর ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ভাঙন এলাকায় মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। তিনি বোমা মেশিন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, ইতোমধ্যে ইউএনওকে এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম আমরা বরদাশত করব না। কেউ নির্দেশনা না মানলে আইনি ব্যবস্থা নেব। আর পাউবোকে বলব এভাবে যাতে টাকার অপচয় করা না হয়, বালু যেখান থেকে তুলবে সেখানেই জিও ব্যাগ ফেলার মানে হয় না।
কুড়িগ্রাম ॥ তিস্তা নদীর ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড জোরেশোরে কাজ করছে। রাজারহাট উপজেলায় তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে সরেজমিনে দেখা গেছে, হাজার হাজার জিও ব্যাগে বালু ভর্তি করার কাজ চলছে। রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের গতিয়াশাম নামক জায়গায় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতে তিস্তা নদীর ভাঙন রোধে প্রতিরোধমূলক কাজ করা হতো না। ফলে প্রতিবছর হাজার হাজার বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়। ভাঙন প্রতিরোধমূলক কাজ দেখে নদীর পাড়ের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ ও প্রাক্তন মেম্বার শহিদুল ইসলাম বলেন, আশা করি এ বছর নদী ভাইঙবার নয়। বাড়ি ঠিক থাকবে।
তিস্তা নদীর উপনদী চাকিরপশা নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ বলেন, নদী রক্ষা সংগঠক তুহিন ওয়াদুদসহ আমরা নদীরক্ষা কর্মী, কয়েক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভাঙন প্রতিরোধমূলক কাজের জন্য অনুরোধ করি। তিনি আমাদের কথা দিয়েছিলেন, ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করবেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বছর তিনেক আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তৎকালীন প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তিস্তা ভাঙন পরিদর্শন করে গেছেন। তিনি জানেন তিস্তার ভাঙনের ভয়াবহতা স¤পর্কে। তাই তিনি ভাঙন প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সে জন্য আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিস্তাপাড়ের স্থায়ী সমাধান জরুরি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা নদীর দুই পাড়ে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার নদীর মধ্যে ভাঙনপ্রবণ এলাকা ৪৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে তীব্র ভাঙনপ্রবণ ২০ কিলোমিটার। এই ২০ কিলোমিটারের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী অর্থবছরে বাকি ২৩ কিলোমিটারের কাজ শুরু হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব এ প্রসঙ্গে বলেন, বর্ষার আগেই জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।
প্যানেল