
ধানমণ্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে পুরান ঢাকা বিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ছবি দেখছেন দর্শনার্থীরা
শহর তার বুকের ভেতর থেকে খুলে নিয়েছে ঢাল/অরক্ষিত যে কোনো দিকে ছুটেছে মানুষেরা ...। কবিতার এই পঙক্তিমালার মতোই শহর ঢাকাও যেন দিশেহারা। স্বস্তির পরিবর্তে অস্বস্তি এসে বাসা বাঁধছে রাজধানীর বুকে। শান্তির বদলে সুযোগ বুঝে বিস্তৃত হচ্ছে অশান্তির ডালপালা। প্রায়শই তুচ্ছ কারণে বিশৃঙ্খলতার উদাহরণ হয়ে উঠছে নগরী। সৃষ্টি হচ্ছে অশান্ত পরিস্থিতি। সেই সুবাদে বিগত সপ্তাহজুড়ে ঘটে গেছে বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা।
ফলশ্রুতিতে শান্তিপ্রিয় নগরবাসীকে পোহাতে হয়েছে নানামুখী বিড়ম্বনা। বিঘœ ঘটেছে সড়কে চলাচল। তেমনই এক ঘটনা ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ। পূর্বের নানা ঘটনার মতোই মঙ্গলবার উভয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। তিন ঘণ্টা ধরে চলেছে তাদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। কাগজ-কলমের পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা হাতে তুলে নিয়েছিল ইটপাটকেল আর লাঠিসোঁটা। ফলশ্রুতিতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে শুরু করে নিউ মার্কেটসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ। এতে আহত হয় সাত ছাত্র।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। নিক্ষেপ করতে হয়েছে টিয়ারশেল বা কাঁদানে গ্যাস। দুই পক্ষের মাঝখানে অবস্থানে আহত হয়েছে কুড়ি থেকে পঁচিশ পুলিশ সদস্য। উভয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিত্যনৈমিত্তিক এই সংঘর্ষ থেকে রেহাই চায় নগরবাসী। নগরের আরেক বিড়ম্বনার নাম ব্যাটারিচালিত রিক্সা। নানামুখী দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠেছে এই যানটি। সেই প্রেক্ষাপটে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে এই যানের চলাচল বন্ধের সূত্র ধরে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় সোমবার।
প্রতিবাদের নামে পুলিশ বক্স থেকে শুরু করে প্যাডেলচালিত রিক্সাচালক ও মোটরসাইকেল চালকের ওপর হামলে পড়ে ব্যাটারি রিক্সাচালকরা। এমনকি আহত হয়েছেন পথচারী থেকে সংবাদকর্মী। অধিকাংশ শহরবাসী এই যানটি সড়কে চলাচলের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও কাজ হচ্ছে না। এমন ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে শহরবাসীকে আরও বেশি ভোগাচ্ছে বায়ু দূষণ। ক্রমাগত দূষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া ক্রমশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে ঢাকা।
মঙ্গলবার দূষণসংক্রান্ত পেশকৃত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকায় গত নয় বছরে নির্মল বায়ু ছিল মাত্র নয়দিন। এমন বাস্তবতায় শহরকে রক্ষায় প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা, বায়ুদূষণকারী ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ, পোড়ানো ইটের বিকল্প ব্লক ইটের ব্যবহার বৃদ্ধিসহ নানা পদক্ষেপ সম্বলিত সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভালোলাগার শিল্পিত শহর ॥ এমন বহুমুখী বিড়ম্বনার মাঝেও ভিন্ন এক সৌন্দর্য রয়েছে শহর ঢাকার। রয়েছে শিল্পিত পরিবেশ। তেমনই মন ভালো করা আয়োজন চলছে ধানম-ির বেঙ্গল শিল্পালয়ের কামরুল হাসান প্রদর্শনালয়ে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার প্রতি রয়েছে যাদের বিশেষ আগ্রহ ঢুঁ দিতে এখানে চলমান ক্রমশ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। আর ক্যামেরার আলো-ছায়ার খেলায় পুরান ঢাকার দিনরাত্রির গল্পটি মেলে ধরেছেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফ। সেই গল্পে মিশে আছে প্রাণের স্পন্দন। ধরা দিয়েছে জীবনের আলোড়ন।
আলোড়িত জীবনের সন্ধানে এই আলোকচিত্রী চষে বেড়িয়েছেন পুরান ঢাকার অলিগলিতে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ঘুরে বেড়িয়েছেন লক্ষ¥ীবাজার, সূত্রাপুর, নারিন্দা, গেন্ডারিয়া, ওয়ারি, মালিটোলা, ছুরিটোলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। সেই সূত্রে পুরনো শহরের মানুষেরা পরিণত হয়েছে তার ছবির বিষয়ে। এসব এলাকার জনগোষ্ঠীর কর্মচাঞ্চল্য থেকে নানা আচার-উৎসবকে ফ্রেমবন্দি করেছেন। বিশেষ করে মুহূর্তকে ধারণ করেছেন অনবদ্য কৌশলে। সে কারণে কোনো সাধারণ দৃশ্যও মূর্ত হয়েছে অসাধারণ প্রকাশে।
নিত্যদিনের উত্থান-পতনের চিত্রকে ফ্রেমবন্দি করেছেন। আদি চৈতন্যে নজর ফেলেছেন সরু গলির প্রাণবন্ত মহল্লা-সংস্কৃতি থেকে প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের পানে। এভাবেই মহল্লাকেন্দ্রিক জনপদের জীবন থেকে সেসব স্থানের নির্যাস বা অস্তিত্বের ভিত্তিকে মেলে ধরেছেন আলোকচিত্রে। পাশাপাশি আধুনিকায়নের বিশ্বে পুরান ঢাকার পরিবর্তনের বৃত্তান্তও উঠে এসেছে মুনেম ওয়াসিফের ছবিতে। অধিকাংশ আলোকচিত্রের মাধ্যম সাদা-কালো। তেমনই এক ছবিতে দৃশ্যায়িত হয়েছে বিউটি বোর্ডিংয়ের অন্দর মহল। একটি ছবিতে ধরা দিয়েছে হোলি উৎসবে মেতে ওঠা আনন্দমুখর কিছু মানুষের মুখচ্ছবি।
দর্শনার্থীদের নজর কাড়ছে সরু গলির ক্ষয়িষ্ণু ভবনের বারান্দায় দুই শিশু-কিশোরীর অবস্থানের দৃশ্যকল্পটি। প্রাণের স্পন্দনময় আরেক ছবিতে ধরা দিয়েছে কোনো এক মহল্লার একঝাঁক শিশু-কিশোরের দুষ্টুমি। আসনে বসে থাকা দর্শকসহ মানসী সিনেমা হলের রূপালী পর্দা চমৎকারভাবে মূর্ত হয়েছে আরেক ছবিতে। রাতের ¯িœগ্ধ আলোয় নির্জনতাকে সঙ্গী করে মূর্ত হয়েছে কোনো এক মহল্লার অনন্য স্থাপত্যশৈলীর কারুকার্যখচিত এক মসজিদ। পুরনো দালানের বারান্দায় বসে নারীর চা পান এবং ছাদের ওপর কিশোরদের হই-হুলোড়ের দৃশ্যের গহিনে অবসরের আনন্দময়তার সন্ধান মেলে। এভাবে প্রতিটি ছবিই পুরান ঢাকার প্রতি কৌতূহল জাগিয়ে দেয় দর্শনার্থীর নয়ন থেকে মনে। আগামী ৩১ মে পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী।
এদিকে নাট্যপ্রেমীদের জন্য ঢাকার মঞ্চে নতুন নাটক নিয়েছে নাট্যদল তাড়ুয়া। যুদ্ধবিরোধী প্রযোজনাটির শিরোনাম ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। জার্মান ঔপন্যাসিক এরিখ মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস অবলম্বনে প্রযোজনাটির নাট্যরূপ দিয়েছেন রুনা কাঞ্চন। নির্দেশনা দিয়েছেন বাকার বকুল। বুধবার থেকে নাটকটির চার প্রদর্শনী শুরু হয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে। আজ শুক্রবার বিকেল চারটা ও সন্ধ্যা সাতটায় নাটকটির মঞ্চায়ন হবে। দুটি বিশ্বযুদ্ধের নির্মম ক্ষতচিহ্ন শরীরে থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীকে কেন যুদ্ধাহত করা হচ্ছে বারবারÑসেই দৃশ্যও তোলা হয়েছে এই নাটকে।
পাশাপাশি মরণঘাতী যুদ্ধের নৃশংসতাকে মেলে ধরা হয়েছে কাহিনীতে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তিকামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের আহ্বান রয়েছে প্রযোজনাটির গল্পের গহিনে। সব মিলিয়ে যুদ্ধবাজদের উন্মাদনার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিফলন এই নাটকের মঞ্চায়ন।
এর বাইরে শিল্পরসিকদের জন্য ঢাকার বিভিন্ন গ্যালারিতে চলছে বেশ কিছু চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার গ্যালারিতে চলছে আলহাম-উল-হক চৌধুরীর ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী ‘দলিলে দৃশ্যপট’। গুলশানের নেদারল্যান্ডসসহ দূতাবাসে দেখা মিলবে হারুন অর রশীদের আঁকা ছবিতে ভঙ্গুর সহাবস্থান শীর্ষক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী।