ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২ নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা  বেশি

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল

প্রকাশিত: ০০:১৪, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২ নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা  বেশি

লবণাক্ততার প্রভাবে কুয়াকাটায় সবুজায়ন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ছোট-বড় ১৩২টি নদ-নদীতে নাব্য সংকটের পাশাপাশি লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও ক্রমশ নামছে। ফলে এ অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েই চলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নগরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসি কমপ্লেক্সে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এখন প্রায় নয় ফুট নিচে নেমে গেছে। উজানে নিয়ন্ত্রণসহ বৃষ্টির অভাবে প্রবাহ হ্রাসের ফলে সাগরের নোনাপানি বরিশাল অতিক্রম করে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলা উপজেলার মেঘনার মূল প্রবাহ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। স্বাভাবিক পাঁচশ’ পিপিএমের স্থলে সাগরপাড়ের কুয়াকাটা থেকে ১১০ কিলোমিটার উজানে বরিশাল মহানগরীর পাশ দিয়ে প্রবহমান কীর্তনখোলা নদীতে এবার সাতশ’ অতিক্রম করেছে।

পিরোজপুরের বলেশ্বরে ১২শ’ এবং বরগুনার পাথরঘাটায় তা প্রায় আড়াই হাজারের উপরে চলে যাচ্ছে। সঙ্গে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামায় চলতি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে আবাদকৃত প্রায় চার লাখ হেক্টরে বোরো ধানের কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, গত নভেম্বর মাস থেকে অনাবৃষ্টিতে বোরোধানে অব্যাহত সেচে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে সেচ ব্যয়ের সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে বৃষ্টির অভাবের সঙ্গে সীমান্তের ওপারে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে নাব্য সংকট প্রকটাকার ধারণ করায় নদ-নদীসমূহে প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয়ে বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা।
যে কারণে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় কোটি মানুষের জন্য অতীতের আশীর্বাদ এসব নদ-নদী যথাযথ সংরক্ষণ ও উন্নয়নসহ ভাঙন রোধে সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবের সঙ্গে প্রকৃতির বিরূপ আচরণে ক্রমশ অভিশাপ হয়ে উঠছে। প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এসব নদ-নদী পরিবেশ সংকটে ক্রমশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। একই সঙ্গে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদীর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের পাঁচশ’ কিলোমিটারে ভয়াবহ নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে নদ-নদীনির্ভর দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এমনকি নাব্য সংকটে প্রায় আড়াই লাখ টন উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতও ক্রমশ বিপদগ্রস্ত করে তুলছে। সারাদেশের আহরিত ইলিশের ৭০ ভাগই যোগান দিয়ে থাকে দক্ষিণাঞ্চল। কিন্তু ক্রমাগত নাব্য সংকটের রেশ ধরে প্রবাহ হ্রাসসহ দূষণে নদী-নদী থেকে ইলিশ উপকূল ছাড়িয়ে গভীর সমুদ্রে চলে যাবার প্রবণতা মৎস্য বিজ্ঞানীদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
নদী বিশেষজ্ঞ এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্রপূর্ণ সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর। যেখানে সবচেয়ে বেশি নদীবিধৌত পানি প্রবেশ করে। আর উজানের পানি সাগরে বয়ে নিয়ে যেতে দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা, তেঁতুলিয়া, বলেশ্বর, বিষখালী, বুড়িশ^র, আগুনমুখাসহ বিভিন্ন নদ-নদী যেমনি বর্ষা মৌসুমে দুইকূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয়। তেমনি নদী ভাঙনও তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু একই নদীতে শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ হ্রাসে নাব্য সংকটে নৌ যোগাযোগসহ মৎস্য ও কৃষি ব্যবস্থাকে বিপন্ন করছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, দেশের তিনটি সমুদ্র বন্দর এবং সারাদেশের সঙ্গে নৌ যোগাযোগও দক্ষিণাঞ্চলে প্রবাহিত মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কীর্তনখোলা, বলেশ্বর, কঁচা, পায়রা ও গাবখান চ্যানেলসহ বিভিন্ন নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল। এরমধ্যে মেঘনাসহ মাঝারি ও বড় নদ-নদীগুলোতে নাব্য সংকটে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে চাঁদপুর হয়ে ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের এবং চট্টগ্রামের নৌ যোগাযোগ ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার প্রশস্ত ভাটি মেঘনায় ডুবোচরে ফেরিসহ সবধরনের নৌযান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে।
তবে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সীমিত কিছু নৌপথের নাব্য ধরে রাখতে পলি অপসারণ করা হলেও পুরো নদী ও তার প্রবাহকে সচল রাখতে কার্যকরী কোনো ভূমিকা রাখা হচ্ছে না। অথচ এসব নদ-নদী পরিবেশ, কৃষি ও মৎস্য সম্পদসহ দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নের চাবিকাঠি হলেও তার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি।

অথচ সারাদেশের নদ-নদীর প্রবাহ সচল রাখতে সর্বাধিক কার্যকরী ভূমিকা রাখছে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদী। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণের অভাবেই এসব নদ-নদীর অনেকগুলোই এখন অস্তিত্ব সংকটে। অথচ নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে ব্যয় যেমনি সাশ্রয়ী, তেমনি নিরাপদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০২০ সালে সেন্টার ফর এনভায়রমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) দক্ষিণাঞ্চলের ৩১টি নৌপথের এক হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার এলাকায় এক সমীক্ষায় নদীসমূহের নাব্য বৃদ্ধি, প্রধান নৌপথের সঙ্গে ঘাটসমূহের সংযোগ স্থাপন, সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলজ সম্পদ বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙন রোধের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। সমীক্ষাকৃত ৩১টি নৌপথের মধ্যে ৪৭০ কিলোমিটারে ৪২ মিলিয়ন ঘনমিটার পলি অপসারণের প্রস্তাব করা হয়েছিল।

পাশাপাশি পরবর্তী সাত বছরে সংরক্ষণ ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে আরও ১৭০ মিলিয়ান ঘনমিটার পলি অপসারণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এ লক্ষ্যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প-প্রস্তাব (ডিপিপি)অনুমোদিত হয়নি। তবে সিইজিআইএস’র প্রস্তাবনার আলোকে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিপিপিতে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীসমূহের নাব্য উন্নয়ন এবং সংরক্ষণসহ লঞ্চঘাটসমূহের উন্নয়নে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০ থেকে ৬৩০ পার্সেন্ট পার মিলিয়ন-পিপিএম।

সেখানে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তা ৯১০ পিপিএমে পৌঁছেছে। ২০১৮ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ২০১৯ সালে একই নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা আবার নয়শ’ পিপিএমে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একই বছর ডিসেম্বরের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়তে শুরু করে। ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে শুরু করে। এপ্রিলের শুরু থেকে কীর্তনখোলায় লবণাক্ততার মাত্রা এক হাজার পিপিএম অতিক্রম করে। এমনকি সাগরের লবণাক্ত পানি বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উজানে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলা উপজেলার মেঘনা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
সূত্রে আরও জানা গেছে, গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতে ২০২১ সালের শুষ্ক মৌসুমে সর্বকালের সর্বোচ্চ ২১শ’ পিপিএম লবণাক্ততা শনাক্ত হয়েছিল। যা ২০১৬ সালে ছিল ১২শ’ পিপিএম। মানবদেহের জন্য সহনীয় লবণাক্ততার মাত্রা ছয়শ’ পিপিএম হলেও শুষ্ক মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক নদ-নদীতেই লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমশ সহনীয় মাত্রার বাইরে চলে যাচ্ছে। যা সুস্থ পরিবেশের জন্য হুমকির সৃষ্টি করছে।

এমনকি নদ-নদীর প্রবহ বাঁধাগ্রস্ত হবার সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে বরিশালে পানির স্তরও ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। খোদ বরিশাল নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ গভীর নলকূপেই শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে পানি মিলছে না। অনেক নলকূপে লবণাক্ত পানি উঠে আসছে।

×