
নড়াইলে নদী ও খালে বাড়ছে লবণাক্ততা
নয়শত আটষট্টি বর্গকিলোমিটার আয়তনের কৃষিপ্রধান জেলা নড়াইল। উপকূল এলাকা না হলেও নড়াইলের নদী ও খালের পানিতে প্রতিবছর লবণাক্ততা বাড়ছে এই জনপদে। লবণ পানি বৃদ্ধির ফলে নদী ও খালের পানি সেচ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে নদী ও খালের পানি সেচ কাজে ব্যবহার করতে পারছে না কৃষকেরা। বাধ্য হয়ে মাটির নিচ থেকে (গ্রাউন্ড ওয়াটার) পানি উত্তোলন করে চাষাবাদ করতে হচ্ছে তাদের। ফলে বোরো আবাদসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে সেচ খরচ বাড়ছে দ্বিগুণেরও বেশি।
প্রতিবছর জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করায় অন্তত ৫ হাজার একর তিন ফসলি জমি এক ফসলি জমিতে পরিণত হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ জনপদের হাজারো প্রান্তিক কৃষক। এদিকে, পলি জমে অধিকাংশ নদী ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ার ভাটা কমে গেছে। এসব নদী ও খালগুলো পুনর্খনন করে জোয়ার ভাটার মাধ্যমে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে পারলে কৃষকেরা নদী ও খালের পানি ব্যবহার করতে পারবে। যেসব এলাকায় লবণাক্ততার মাত্রা বেশি সেই এলাকার কৃষকদের গম, সূর্যমুখী, ভুট্টাসহ বিভিন্ন লবণসহিষ্ণু ফসল চাষাবাদের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানালেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। এ খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
প্রায় আট লক্ষ মানুষের বসবাসের এ জেলা বিল ও ঘের বেষ্টিত। এ জেলার মানুষের প্রধান জীবিকার উৎস কৃষি কাজ ও মৎস্য চাষ। জেলায় তেমন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় এ জনপদের ৮২ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। নড়াইল জেলার মধুমতী, আফরা, নবগঙ্গা ও চিত্রা নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে সেচের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বিভিন্ন খাল, বিল ও জলাশয়ের পানি। ফলে বিপাকে পড়েছে তার মতো হাজারো প্রান্তিক কৃষক। বাধ্য হয়ে এসব কৃষকেরা মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করে জমিতে সেচ দিচ্ছে।
ফলে এসব এলাকার কৃষকদের সেচ খরচ বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বেশ কয়েকবছর ধরে নড়াইলের নদী ও বিভিন্ন খালে মার্চ থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত লবণ পানি প্রবেশ করায় নড়াইল সদর ও কালিয়া উপজেলার কয়েক হাজার কৃষকেরা নদী ও খালের পানি ব্যবহার করতে পারছে না। আর প্রতিবছর পানিতে লবণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছ। ফলে কৃষকেরা বাধ্য হয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
যশোর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, নড়াইল জেলায় ২০০০ সালের একটি সার্ভে রিপোর্টে পানিতে প্রথম লবণাক্ততা ধরা পড়ে। তখন এর এরিয়া ছিল ১৬ হাজার হেক্টর জমি। পরে ২০০৯ সালের সার্ভেতে প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে লবণাক্ততা ধরা পড়ে। এরপর গতবছর একটি সার্ভে করা হয় কিন্তু তার ফলাফল এখনো প্রকাশ করা হয়নি। কৃষি জমিতে সেচ উপযোগী পানিতে লবণের স্বাভাবিক মাত্রা ধরা হয় ০.৭৫ ডিএস/মিটার। পানিতে লবণের মাত্রা এর বেশি হলে সেচ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় নদী ও খালের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ১.৭৫ ডিএস/মিটার পর্যন্ত দেখা গেছে।
যশোর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোতাসীম আহমেদ বলেন, নড়াইল জেলার মধুমতি নদীর কালনাঘাট, নবগঙ্গা নদীর বারইপাড়া, চিত্রা নদী আওড়িয়া এবং আফরা নদীর তুলারামপুর পর্যন্ত এর পানি বছরের একটা সময় পর্যন্ত লবণাক্ত থাকে। নদীর পানি ও লবণাক্ততা প্রধানত উজান থেকে পানির প্রবাহ এবং উজানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। উজানে পানির প্রবাহ বেশি এবং অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হলে লবণাক্ততা কমে যায়।
সদর উপজেলার মুলিয়া গ্রামের কৃষক রতন ঘোষ বলেন, লবণ পানি প্রবেশ করায় মুলিয়া, বাহিরগ্রাম আকদিয়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকার কৃষকেরা জমিতে বছরে একটি ফসলের বেশি আবাদ করতে পারছে না। অথচ এ সকল এলাকায় কয়েকবছর আগেও বছরে ৩টি করে ফসল ফলাতো কৃষকেরা। কালিয়া উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের কৃষক পিকুল শেখ বলেন, জমিতে যখন সামান্য লবণ পানি প্রবেশ করে তখন জমিতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করতে হয়।
আর যখন পানিতে লবণের মাত্রা বেশি থাকে তখন খেতের ফসল সব নষ্ট হয়ে যায়। জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করায় নড়াইল সদর ও কালিয়া অঞ্চলে অন্তত ৫ হাজার একর ৩ ফসলি জমি ১ ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ জনপদের হাজারো প্রান্তিক কৃষক। ব্যাহত হচ্ছে বোরোসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন।
সদর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. রোকনুজ্জামান বলেন, যেসব এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করছে সেসব এলাকার কৃষকেরা তাদের জমিতে বাধ্য হয়ে সার বেশি ব্যবহার করছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা। এসব এলাকার কৃষকদের লবণসহিষ্ণু ফসল চাষাবাদের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি উপ-পরিচালক কৃষিবিদ জসিম উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন এলাকার বিলে যেসব খাল রয়েছে সেসব খাল অধিকাংশ ভরাট হয়ে জোয়ার ভাটা কমে গেছে। নদী ও খালগুলো পুনর্খনন করে জোয়ার ভাটার মাধ্যমে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে পারলে কৃষকেরা নদী ও খালের পানি ব্যবহার করতে পারবে। তখন সেচ খরচ অনেক কমে যাবে। যেসব এরিয়ায় লবণাক্ততার মাত্রা বেশি সেই এলাকার কৃষকদের গম, সূর্যমুখী, ভুট্টাসহ বিভিন্ন লবণসহিষ্ণু ফসল চাষাবাদের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন।