ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

রংপুর অঞ্চলের শতরঞ্জি

নান্দনিক নকশা বহুমুখী ব্যবহার, রপ্তানি হচ্ছে ৩৬ দেশে

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ২২ এপ্রিল ২০২৫

নান্দনিক নকশা বহুমুখী ব্যবহার, রপ্তানি হচ্ছে ৩৬ দেশে

নারীদের হাতে বুনন শৈলী শতরঞ্জি

চাহিদা বৃদ্ধি, তাঁত প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা এবং বর্ধিত বিপণনের কারণে গত কয়েক দশকে এটি প্রসার লাভ করেছে। ‘বাহের দ্যাশ’খ্যাত রংপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বয়ন বা বুননশৈলী শতরঞ্জির কথা বলা হচ্ছে। পরিবর্তন এসেছে এর নকশাতেও। সাদামাটার রূপ ঘুচিয়ে বর্তমানে শতরঞ্জি দারুণ বাহারি, বর্ণিল। আগে এর প্রধান উপকরণ ছিল পাট, বর্তমানে গার্মেন্টসের ঝুট থেকে সুতা তৈরি করে তা দিয়ে বানানো হচ্ছে শতরঞ্জি।

নান্দনিক নকশা, বহুমুখী ব্যবহার, সাশ্রয়ী দাম ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিদেশেও জায়গা করে নিয়েছে এই শিল্প। খটখট শব্দে প্রতিদিন বোনা হয় ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি। অথচ এটি এক সময় বিলুপ্তি হতে বসেছিল। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারায় ২০২১ সালে শতরঞ্জি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছ থেকে পেয়েছে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি। প্রতিটি কারখানায় বর্তমানে  প্রায় ২০ হাজার নারী এই বুনন শিল্পে হয়েছেন স্বনির্ভর। অভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়াও রপ্তানি হচ্ছে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ৩৬টিরও বেশি দেশে। আর এই হস্তজাতশিল্প থেকে বছরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।
সচেতন মহল বলছে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া শতরঞ্জিকে নিয়ে প্রয়োজন বিশেষ পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামীণ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার নারী ও পুরুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সল্প সুদে ঋণ প্রদান করা গেলে এই শিল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করা সম্ভব।
রংপুর বিভাগীয় শহরের পশ্চিমে ঘাঘট নদীর তীর ঘেঁষা নিশবেতগঞ্জ গ্রাম। গ্রামটি এই শিল্পের উর্বর ভূমি হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে প্রতিটি কারখানায় খটখট শব্দে প্রতিদিন বোনা হয় ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি। যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই কেবল বাঁশ, কাঠ ও রশির মাধ্যমে পাট, সুতা কিংবা গার্মেন্টসের ঝুট দিয়ে হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় শতরঞ্জি। এ ছাড়াও নগরীর রবার্টসনগঞ্জে রয়েছে কারুপণ্য নামে শতরঞ্জির সুবিশাল কারখানা। পাশাপাশি নীলফামারী, বদরগঞ্জ ও তারগঞ্জে গড়ে উঠেছে আরও কিছু শতরঞ্জির কারখানা।
ইতিহাস বলছে শতরঞ্জি মুঘল সাম্রাজ্যের সময় থেকে তৈরি হতো।  বুনন কৌশলগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একই তাঁতি পরিবারগুলোর মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৩০ এর দশকে, ব্রিটিশ সরকারি কর্মচারী এবং রংপুরের তৎকালীন কালেক্টর মিসেস নিসবেট রংপুরের নিকটবর্তী পীরপুর গ্রাম পরিদর্শন করেন। এর ফলে তিনি স্থানীয় গ্রামগুলো আবিষ্কার করেন যেখানে স্থানীয়রা শতরঞ্জি ব্যবহার করে বুনন করতেন।

পণ্যটি দেখে মুগ্ধ হয়ে নিসবেট তার সরকারি প্রভাব ব্যবহার করে এটি প্রচার করেন; তার সম্মানে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় নিসবেটগঞ্জ। ব্রিটিশ শাসনামলে, শতরঞ্জি কার্পেট সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে সাধারণ হয়ে ওঠে, শ্রীলঙ্কা, বর্মা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করা হতো। বর্তমান যুগে এসেও এর চাহিদা ও রপ্তানি বেড়েছে।
শতরঞ্জি একটি বয়নশৈলী তাঁত প্রক্রিয়া। এতে কোনো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না। শতরঞ্জি বুনতে ব্যবহৃত সবচেয়ে সাধারণ উপকরণ হলো সুতির সুতা, পাটের সুতা, পশম ইত্যাদি। তন্তু দিয়ে তৈরি দড়িগুলো জ্যামিতিক নকশায় বোনা হয়, সাধারণত হাতে পরিমাপ করা হয়। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন, অনন্য জ্যামিতিক নকশা এবং নকশা তৈরি করতে বিশেষ কৌশল এবং বিভিন্ন রং ব্যবহার করা হয়। নকশাগুলো তাঁতিদের নিজস্ব দক্ষতা, কৌশল এবং শৈলীর প্রতিনিধিত্ব করে। এটি ফ্যাশনেবল, শৈল্পিক এবং ব্যবহারিক কার্পেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে যখন এটি একটি কম্বল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এর উৎপাদন ব্যয়ের কারণে, শতরঞ্জি ঐতিহাসিকভাবে অভিজাতদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাধারণত, একটি শতরঞ্জি কমপক্ষে ৩০ বাই ২০ ইঞ্চি পরিমাপ করে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ৩০ বাই ২০ ফুট। ৬ বাই ৯ ফুট কার্পেটের জন্য দুজন শ্রমিককে পুরো দুইদিন কাজ করতে হয়, যেখানে ১.৫ বাই ৩ ফুট কার্পেটের জন্য একজন তাঁতিকে ৩ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। 
শতরঞ্জি পল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, শত শত নারী শতরঞ্জি বুননে ব্যস্ত। শেফালি বেগম এক নারী শ্রমিক বললেন, দীর্ঘ ২০ বছর থেকে কাজ করছি। দুইটা ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি কিছু জমি জায়গাও কিনছি। এই শতরঞ্জির কাজ করে সংসারটা ভালোই চলে। রাশেদা বেগম আট বছর ধরে কাজ করছেন এই কারখানায়। তিনি বলেন, শতরঞ্জি বুননের টাকায় যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলছে। অর্ধেক টাকা ডিপিএস এ জমা করি আর বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতে স্বামীকে সাহায্য করি।

সুলতানা আক্তার, মাছুমা খাতুন, আছিয়া খাতুন, রঞ্জিনা বেগম, আজমিয়া বেগম, মৌসুমী বেগমসহ আরও অনেকেই বললেন, হস্তজাত এই শতরঞ্জি শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে তাদের জীবন-জীবিকা চলছে। প্রতিদিন একজন শ্রমিক ১০ থেকে ১৫ বর্গফুট শতরঞ্জি বুনতে পারেন। প্রতি বর্গফুটে তারা ১৫ টাকা করে মজুরি পেয়ে থাকেন।
শতরঞ্জি পল্লি স্বত্বাধিকারী মনিরা বেগম বলেন, এই শিল্পটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বর্তমানে দক্ষ কারিগরের বড্ড অভাব। বিসিক থেকে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তা একেবারে অপ্রতুল। তিনি বলেন, সরকার যদি এই শিল্পের প্রতি বাড়তি যতœ নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করত তা হলে এই শিল্পের আরও প্রসার ঘটত।
চারুশী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী তহুরা বেগম বলেন, শতরঞ্জি রপ্তানিতে প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার আয় হলেও এই শিল্পে সকারের যেমন নজর দেওয়া দরকার তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এসএমই বা বিসিক সঠিকভাবে কাজ করে না। অথচ বিশেষ নজর দেওয়া গেলে এই শিল্পে আরও ব্যাপক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যেত। শতরঞ্জিসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তজাত শিল্প প্রতিষ্ঠান আপনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অষিত চৌধুরী বলেন, এসএমই ও বিসিক যে মেলাগুলো করে সেখানে হস্তশিল্পের প্যাভিলিয়ন দেওয়ার পাশাপাশি যদি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতো তা হলে আমরা সহজেই অংশ নিয়ে এই শিল্পের আরও প্রসার ঘটাতে পারতাম। একই সঙ্গে আমরা যারা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রণোদনাসহ কম সুদে ঋণের ও কাঁচামালের সহজলভ্যতা করত তা হলে এই শিল্পের প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বাড়ানো যেত।

আরো পড়ুন  

×