
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার শায়েস্তানগর এলাকার বানাতুল মেসলেমীন দাখিল মাদ্রাসায় ঘটে যাওয়া একটি দুঃখজনক ঘটনার পর, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মুক্তা মাদ্রাসা ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। স্কুলে যাওয়ার পথে একদল বখাটের দ্বারা নিত্যদিনের উত্ত্যক্ততা, হুমকি এবং শারীরিক হয়রানির কারণে তার শিক্ষা জীবন থেমে গেছে। প্রশাসনের নিরবতা, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়া এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অসংবেদনশীল আচরণ এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে ভুক্তভোগী, শিক্ষক শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে উঠে আসে এই চিত্র।
পশ্চিম চরপাতা গ্রামের মনির হোসেনের মেয়ে মুক্তা প্রতিদিন মাদ্রাসা যাওয়ার পথে হয়রানির শিকার হন। একদিন তার পথরোধ করে দুই বখাটে মোবাইল নম্বর চাওয়া হয়, মেয়ে চিনিনা আপনাকে কেন মোবাইল নাম্বার দিব বললে পথরোধ করে দাঁড়ায় সে। জোর করে টেনে হেঁচড়ে ভিডিও ধারন করতে থাকে অপর যুবক। মেয়ে কাকুতি মিনতি করে মোবাইল নাম্বার দিতে অস্বীকৃতি জানালে, বখাটেরা তার ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। ভিডিও ধারণের সময় টানা-হেঁচড়া শুরু হলে স্থানীয় কিছু পথচারীর হস্তক্ষেপে সে রক্ষা পায় তখন সে।
সুমাইয়া আক্তার মুক্তা জানান “প্রতিদিন ভয়ে থাকি। মা-বাবার কাছেও সব বলতেও পারিনি। এখন আর সাহস হয় না বাইরে যেতে।” মুক্তার বাবা বলেন, “ঘটনার পরপরই আমরা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানাই। কিন্তু তারা বিষয়টি 'ছোট ঘটনা' হিসেবে দেখিয়ে আমাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে। আমাদের বলা হয়েছে—‘সমঝোতা করে ফেলুন’। তাই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।”
শায়েস্তানগর এলাকার আমিও বিএনপি নেতা খোরশেদ ঢালী বলেন, ঘটনার বিবরণ শুনে আমি বিস্মিত হই। এই মাদ্রাসায় এরকম ঘটনা আগেও হয়েছে। কিছু ছেলে আশপাশে ঘোরাফেরা করে মেয়েদের উত্যক্ত করে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয়। কেউ প্রতিবাদ করলে উল্টো বিপদে পড়ে। আমি চাই এ ধরনের বখাটেদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হোক। ”
মাদ্রাসার এক সাবেক ছাত্রী বলেন, “আমি নিজেও একসময় এখানে পড়তাম। আমার এক বান্ধবীকেও একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন ভূঞা বলেন, “আমাদের কাছে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।”
অন্যদিকে, রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: ইমরান খান বলেন, “মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হবে। তবে বিষয়টি বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
লক্ষ্মীপুর জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, “এটি শিশু নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। এখানকার অভিভাবকরা সচেতন হলে এবং প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে পদক্ষেপ নিলে অপরাধীরা শাস্তি পেত। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা অনেক সময় বিচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।”
ব্র্যাকের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৪% স্কুলগামী মেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্তের শিকার হয়।
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১৫০০+ কিশোরী উত্ত্যক্ত বা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৩৮% শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে।
এই একটি ঘটনা হাজারো মেয়ের কণ্ঠস্বর। মুক্তা প্রতিনিয়ত যারা আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তাদের প্রতীক। সমাজ, প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সব পক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে। শুধুমাত্র শাসন নয়, চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন নিরাপদে বিদ্যালয়ে যেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ও সমাজের যৌথ দায়িত্ব। প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি আহ্বান—এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনুন, নয়তো এরকম আরেকটি মুক্তা হারিয়ে যাবে শিক্ষা ও স্বপ্নের জগৎ থেকে।
রিফাত