ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২

১০ লাখ টাকা না পেয়ে ক্রসফায়ার! ডিবির সাবেক ওসিসহ ১৭ পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ

নিজস্ব সংবাদদাতা, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ১৮:২৫, ২১ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১৮:২৮, ২১ এপ্রিল ২০২৫

১০ লাখ টাকা না পেয়ে ক্রসফায়ার! ডিবির সাবেক ওসিসহ ১৭ পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ

ছবি: সংগৃহীত

ময়মনসিংহে গত ২০১৮ সালের ২৪মে নগরীর পুরোহিত পাড়া রেলওয়ে পুকুরপাড় এলাকায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ক্রসফায়ারে নিহত রাজন হত্যা মামলায় জেলা গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি আশিকুর রহমান সহ ১৭পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে পিবিআইকে তদন্ত পূর্বক রিপোর্ট প্রদানের আদেশ প্রদান করেছে বিজ্ঞ আদালত।

রবিবার (২০ এপ্রিল) বিকেলে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ নম্বর আমলী আদালতের বিচারক শরিফুল হক এই আদেশ প্রদান করেন।

এই তথ্য নিশ্চিত করে ময়মনসিংহ আদালতের পুলিশ পরিদর্শক মুসতাসিনুর রহমান জানান, গত বছরের ৩১ অক্টোবর নিহত রাজনের পিতা হারুন অর রশিদ পুত্রের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলা গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি আশিকুর রহমানসহ ১৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এক নম্বর আমলী আদালতে অভিযোগ দাখিল করেন। ওই মামলায় রবিবার বিকেলে বিজ্ঞ বিচারক অভিযোগ তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদানের জন্য জেলা পিবিআইকে নির্দেশ প্রদান করেছেন।
মামলায় অন্য আসামিরা হচ্ছে পুলিশ পরিদর্শক মুখলেসুর রহমান, কনস্টেবল কাউসার হাবীব, কনস্টেবল গুলজার, কনস্টেবল সোহরাব আলী, এসআই ফারুক আহমেদ, এস আই পরিমল চন্দ্র দাস, এস আই আকরাম হোসেন, এএসআই আব্দুল মজিদ, এএসআই জিন্নাত হাসান মানিক, এএসআই জাকির হোসেন, এএসআই জিল্লুর রহমান, কনস্টেবল সাইদুল, কনস্টেবল সেলিম, কনস্টেবল রাশেদুল, কনস্টেবল সানোয়ার ও কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২২ মে মধ্যরাতে জেলা গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে আরো বেশ কিছু সদস্য পুলিশের পোশাক পরিহিত অবস্থায় নগরীর পুরোহিত পাড়ার হারুন অর রশিদের বসত বাড়িতে এসে তার পুত্র রাজনকে ঘুম হইতে উঠিয়ে আটক করে।

হারুন অর রশিদ পুত্রকে আটকের বিষয়টি জানতে চাইলে ওসি আশিকুর রহমান বলেন, আপনার ছেলেকে কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছুক্ষণ পরে আবার ছেড়ে দেয়া হবে। পরের দিন সকাল দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে পুত্র রাজন বাড়িতে না আসায় মামলার বাদী হারুন অর রশিদ জেলা গোয়েন্দা অফিসে গেলে বাদিকে তাহার আটককৃত পুত্র সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। কোনো তথ্য না দিয়ে দীর্ঘ সময় তাকে বসিয়ে রাখে। পরে রাজনকে দূর হতে জেলা গোয়েন্দা অফিসের ভেতর লকআপে আটক অবস্থায় দেখতে পায়। এর পরের দিন ২৪ মে বৃহস্পতিবার সকাল দশটার সময় পরিবারের লোকজনকে সাথে নিয়ে হারুন অর রশিদ জেলা গোয়েন্দা অফিসে গেলে ওসি আশিকুর রহমান তাকে ডেকে নিয়ে রাজনের জীবনের বিনিময়ে দশ লক্ষ টাকা দাবি করেন এবং হুমকি দেন রাত দশটার মধ্যে দশ লক্ষ টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তার পুত্র রাজনকে ক্রসফায়ার করা হবে। ওসি আশিকুর রহমানের এমন কথা শুনে বাদী তার পা ধরে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চায় এবং পুত্রকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে। এসময় বাদীকে ডিবি কার্যালয় থেকে বের করে দিয়ে টাকা জোগাড় করে আনতে বলে।

বাদী হারুন অর রশিদ পুত্র রাজনকে ছাড়ানোর জন্য চাহিদার টাকা জোগাড় করতে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে ২ টার সময় পুরোহিত পাড়ার রেলওয়ে পুকুরপাড় এলাকায় লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পায়। বাদি হারুন অর রশিদ ঘুম থেকে উঠে রেলওয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখতে পায় তার পুত্র রাজনকে হাত বাঁধা অবস্থায় ঘটনাস্থলে দাঁড় করে রেখেছে। পরে ডিবির ওসি আশিকুর রহমানের নির্দেশে অন্যান্য বিবাদীগণ হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে উপস্থিত লোকজনকে তাড়িয়ে দেয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়া হত্যা করার উদ্দেশ্যে রাজনের বুকের নিচে ও পেটে সরাসরি গুলি করলে রাজন মাটিতে লুটাইয়া পড়ে। ঘটনাস্থলেই রাজনের মৃত্যু হয়। পরে মৃত রাজনের লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় ডিবির পুলিশ সদস্যরা। পরদিন ২৫ মে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারে হাতে রাজনের লাশ হস্তান্তর করে।

পরবর্তীতে বাদী কোতোয়ালি থানায় গিয়া পুত্র রাজন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য গেলে খবর পেয়ে ডিবির ওসি আশিকের নির্দেশে বিবাদীগণ বাদী হারুন অর রশিদকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাকেও ক্রসফায়ারে হত্যা করার হুমকি দেয়। নিজের জীবন বাঁচাতেই রাজনের পিতা হারুন অর রশিদ মামলা দায়ের করা থেকে বিরত হয়।
এরপর ২০২৪ সালে ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে মামলাটি করেন নিহত রাজনের পিতা।

পিবিআই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সত্য ঘটনা উদ্‌ঘাটন করে আদালতে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করবেন এমনটাই প্রত্যাশা মামলার বাদী হারুন অর রশিদের।

মামলার বাদী হারুন অর রশিদ জানান, ডিবির সাবেক ওসি আশিকুর রহমান তাঁর পুত্র রাজনকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করে তার ছোট ভাই আলালকে ওই মামলার এক নাম্বার আসামি করেছে এবং আরো ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এই মিথ্যা মামলাটি বাতিল করার জন্য আদালতের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।

মামলার বাদীর আইনজীবী সালাহ উদ্দিন পাঠান জানান, দীর্ঘদিন পর বিজ্ঞ আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত করার জন্য জেলা পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছে। তিনি আরো জানান, চাহিদার ১০ লক্ষ টাকা না পেয়ে ক্রসফায়ারে নামে ডিবির সাবেক ওসি আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে গুলি করে রাজনকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর নিহত রাজনের চাচা আলালকে ওই মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এই ঘটনাটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরে বিজ্ঞ আদালত নিশ্চয়ই মামলার বাদির পক্ষে এ বিষয়ে আদেশ দিবেন। বাদী আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পাবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা জানান তিনি।

এই বিষয়ে জানতে ডিবির সাবেক ওসি আশিকুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

শেখ আব্দুল আওয়াল / ফারুক

×