ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২

জৌলুশ হারাচ্ছে গ্রামীণ হাট, বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র 

শফিকুল ইসলাম শামীম, রাজবাড়ী

প্রকাশিত: ১৬:০৭, ২০ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১৬:১৮, ২০ এপ্রিল ২০২৫

জৌলুশ হারাচ্ছে গ্রামীণ হাট, বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র 

ছবি: জনকণ্ঠ

এক সময় সপ্তাহে দুই দিন গ্রামীণ হাট ছিলো উৎসবের মতো। কৃষকরা হাটে আসতেন তাঁদের পরিশ্রমের উৎপাদিত ফসল, গবাদি পশু, দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি বিক্রি করতে। আবার সেখান থেকেই সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, কাপড়, দা-কুড়াল কিংবা সন্তানদের জন্য খেলনা কিনতেন।

হাটের দিন যেনো পুরো গ্রাম জেগে উঠতো নতুন প্রাণে। কোথাও পিঁড়িতে বসিয়ে চুল কাটার ধুম, কোথাও সিঙ্গাড়া-পুরি-চপের দোকানে ভিড়, নানা রঙের চানাচুর, বিস্কুট আর নিমকির স্বাদ যেনো আজও মুখে লেগে আছে প্রবীণদের। কিন্তু সেই চেনা চিত্র এখন কেবলই স্মৃতি।

আজকের গ্রামীণ হাট আর আগের মতো প্রাণবন্ত নেই। অধিকাংশ হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি কমে গেছে। অনেক হাট বন্ধ হওয়ার উপক্রম। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজবাড়ী সদর উপজেলায় উড়াকান্দা হাট বাজার, উদয়পুর হাট, কুটি পাচুরিয়া হাট-বাজার, কুটির হাট, কোলার হাট, খানখানাপুর হাট-বাজার, দাদশী মাজার বাজার, বরাট হাট-বাজার, বসন্তপুর হাট, বাগমারা হাট, সূর্যনগর হাট। 

গোয়ালন্দ উপজেলায় রয়েছে কাঁটাখালী বাজার, গোয়ালন্দ হাট-বাজার, চর দৌলতদিয়া হামিদমৃধার হাট-বাজার, জামতলার হাট, দৌলতদিয়া হাট-বাজার। বালিয়াকান্দি উপজেলায় জঙ্গঁল হাট, জামালপুর হাট, ত্রিমোহনী, নারুয়া, বহরপুর, বাওনারা, বালিয়াকান্দি, বেরুলী, রামদিয়া, সমাধীনগর, সোনাপুর। 

কালুখালী উপজেলায় অরুনগঞ্জ হাট, কমকলিয়া হাট, গান্দিমারা হাট, চাঁদ মৃগী হাট, ঠাকুরপাড়া হাট, বাংলাদেশ হাট, বাহের মোড় হাট, মদাপুর হাট, মালিয়াট রেল ষ্টেশন হাট, রতনদিয়া হাট, রায়নগর সুইচ গেট হাট, লাড়ীবাড়ী হাট।

পাংশা উপজেলায়  জোনা হাট, পারডেমনামারা হাট, বয়রাট হাট, বাগদুলী হাট, বাহাদুপুর হাট, বৃত্তিডাঙ্গা হাট, মাচপাড়া হাট, যশাই বাজার হাট, শরিষা হাট, সেনগ্রাম হাট, হাটবনগ্রাম হাট ও হাবাসপুর হাটসহ জেলায় মোট ৫৩টি হাট-বাজার রয়েছে। তবে সব হাটগুলো এখন জৌলুস হারিয়েছে।

 

সদর উপজেলার বসন্তপুর হাটের ষাটোর্ধ্ব রবি শীল বলেন, আগের মত সেই হাট এখন নেই। এই হাটে সপ্তাহে দুই দিন হতো। সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত চলতো মানুষের কোলাহল। কিন্ত এখন সেই চিত্র চোখে পড়ে না। হাটে মানুষ দেখা যায় না। এ পাশ থেকে অন্য পাশে দেখা যায়। তিনি বলেন, এই অবস্থার অন্যতম কারণ রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা দোকানপাট, মার্কেট ও শহরমুখী মানুষের ঝোঁক। মোবাইল ফোনে অনলাইন কেনাকাটা, শহরের সুপারশপ ও বাজারের সহজলভ্যতা থেকেও পিছিয়ে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী হাট।

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার রাম ভৌমিক নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, “আগে হাটে দিন গড়ালেই মানুষ জমতো। এখন তো কেউ আর আগের মতো আসে না। দোকানপাটে যা লাগে, সব পেয়ে যায়।”

অথচ এই হাটগুলো ছিলো গ্রামের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। কৃষকের আয়ের মূল জায়গা ছিল এই হাট। শুধু কেনাবেচা নয়, হাট ছিল সামাজিক মিলনের এক বড় জায়গাও।

কালুখালী উপজেলার ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি বলেন, একটি সময় হাটের দিন গ্রামের মানুষ দল বেঁধে আসতো। এক সাথে বাজার করে সবাই মিলে আবার বাড়ীতে ফিরে যেত। নদীর পার ঘেষা বাসিন্দারা নৌকা নিয়ে চলে আসতো হাটে। বেচা-বিক্রি করে আবারও চলে যেত। কিন্ত সেই চিরচেনা চিত্র এখন চোখে পড়ে না। হাটে আর আগের মত ব্যস্ততা নেই। 

তবে অনেকে মনে করেন, গ্রামীণ অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে হাট ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও পুনর্জাগরণ করতে হবে। হাটে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, সুষ্ঠু পরিবেশ এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করলে আবারো ফিরে আসতে পারে হাটের পুরোনো প্রাণ। গ্রামীণ হাটের জৌলুশ ফিরে পেতে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা। না হলে একটি সময় হারিয়ে যাবে এক অনন্য সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ঐতিহ্য।

শহীদ

আরো পড়ুন  

×