
পান্ডা ছবি: জনকণ্ঠ
চীনের সুখী শহরের তালিকায় শীর্ষে সিচুয়ানের চেংদু সিটি। রাজধানী চেংদু পান্ডা শহর একনামেই শুধু চীন নয় গোটা বিশ্ববাসীর কাছেই পরিচিত। কারণ দেশটির মোট পান্ডায় প্রায় ৯০ শতাংশই রয়েছে শহরটিতে। বলতে গেলে পুরোটা সবুজে ঘেরা চেংদু পান্ডা প্রজনন ও গবেষণা কেন্দ্রে। যা এখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার একটি বিশ্বব্যাপী প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেখানে বর্তমান পৃথিবীতে জীববৈচিত্র হুমকি মুখে সেখানে প্রদেশটির চেংদু পান্ডা প্রজনন ও গবেষণা কেন্দ্র বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রাণী সংরক্ষণ এবং পরিবেশ রক্ষায় দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চেংদু শহরে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রজনন ও গবেষণা কেন্দ্রটি এখন পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণও বটে। সড়কপথে চেংদু শহরে প্রবেশের আগেই বিভিন্ন রাস্তার মোড় থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট স্থাপিত পান্ডার বিশালাকৃতির প্রতিকৃতি এবং ছোট বড় নানা ধরনের ব্যাগ, টি শার্ট, খাতাসহ বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্রে পান্ডার ছবিই এটি পান্ডার আবাসস্থল। এযেন পান্ডারই শহর। প্রজনন ও গবেষণা কেন্দ্রের বাইরে পান্ডার উপস্থিতিই এক পর্যটককে নিয়ে যায় পান্ডার ভুবণে। সিচুয়ানে ঠান্ডাকালে পান্ডা থাকে বদ্ধ ঘরের বাইরে। আর গরমকালে তাদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য ২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা নীচে রাখা হয়ে থাকে। গরম একদমই সহ্য করতে পারে না বলে পান্ডাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়ে থাকে। মূলত মাংসাষী প্রাণী হলেও পান্ডাদের পছন্দের খাবার বাঁশ। বাশ পেলে আর পান্ডার কথাই নেই। সেই কারণে কেন্দ্রের শুধু ভিতরেই নয় আঁশপাশেই শুধু বাঁশের বন। সেখানে নানা প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো বড় আকারের বাঁশের সংখ্যা সেখানে কম থাকে।
সারাবিশ্বেই পান্ডা এখন বিলুপ্তির পথে। কিন্তু সিচুয়ানের সেটির ব্যতিক্রম। চীনের পান্ডার শহর চেংদুতেই রয়েছে প্রায় ২শ বেশি পান্ডা। এর মধ্যে রয়েছে দৈত্যাকার পান্ডা এবং লাল পান্ডা। লাল পান্ডাগুলো আকারে বেশ ছোট অন্য পান্ডার চেয়ে। চেংদুর বাইরেও অন্য প্রদেশের কিছু কিছু পান্ডার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে সেটির পরিচিতি তেমন নয়। চেংদুর পান্ডা সংরক্ষণ কেন্দ্রটি প্রতীকী প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশের জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষার মডেল হিসেবেও কাজ করছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব কিছু বৈচিত্র রয়েছে, যা শুধু সেখানেই পাওয়া যায়। চীন পান্ডা সংরক্ষণ ও প্রজননের মাধ্যমে যা আজ করছে, তা বিশ্বের অন্যান্য দেশ আগামীতে করতে পারে। যেমন বাংলাদেশের অহংকার সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার - যা বাংলার প্রতীক এবং জাতীয় গর্বের উৎস। এটিকেও পান্ডার আদলে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। যদিও সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় এখন সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে যা যথার্থ নয়।
সিচুয়ানের বাসিন্দারা জানান, গত কয়েক দশক ধরে গবেষণা, প্রজনন কর্মসূচি এবং জনশিক্ষার মাধ্যমে চেংদুর কেন্দ্রটি কেবল পান্ডার সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেনি বরং সমগ্র গ্রহের স্বাস্থ্যের জন্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্বও সবার সামনে উত্থাপন করেছে।
গত মার্চ মাসে চেংদুর পান্ডা প্রজনন ও গবেষণা কেন্দ্র সরেজমিনে দেখা গেছে, হাক্কা বৃষ্টিতে ভিজে ৯-১০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্যে খাচার বাইরে থেকে দর্শনার্থীরা বাঁশ খাওয়া ও গাছে ঘুমাচ্ছে এমন পান্ডাদের দেখতে ভিড় করছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ বৃদ্ধ এবং তরুণরা কৌতূহলী চোখে এই প্রাণীদের দিকে তাকিয়ে মধুর স্মৃতি ধরে রাখতে তাদের মোবাইল ফোনে ছবি তুলে রাখছে।
গবেষকরা জানান, দ্বৈতাকার পান্ডা চীনের জাতীয় সম্পদ যা বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি প্রজাতি হিসেবে পান্ডাদের রক্ষা করার অর্থ হল তাদের বসবাসকারী বিশাল বাঁশের বন সংরক্ষণ করা, যা ফলস্বরূপ অগণিত অন্যান্য প্রজাতির সহায়তা করে। চেংদু সেন্টার সফলভাবে বেশ কয়েকটি পান্ডাকে প্রজনন এবং বন্য অঞ্চলে ছেড়ে দিয়েছে, যা তাদের জনসংখ্যার ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারে অবদান রেখেছে। এই অর্জন বিপন্ন প্রজাতির পতন রোধে সমন্বিত সংরক্ষণ প্রচেষ্টার গুরুত্বকে তুলে ধরে।
চেংদু পান্ডা প্রজনন কেন্দ্রের সাফল্য আশা জাগিয়ে তুললেও, এটি বিশ্বব্যাপী অন্যান্য বিপন্ন প্রজাতিগুলিকে রক্ষা করার জরুরি প্রয়োজনীয়তারও স্মারক হিসেবে কাজ করে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের বিখ্যাত প্রজাতি রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ চীন থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং তাদের সাথে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগার সহ বন্য প্রাণীদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। যেহেতু উভয় দেশেরই জাতীয় প্রাণী রয়েছে। সেই কারণে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশই বিপন্ন প্রজাতিগুলিকে সংরক্ষণে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
বর্তমানে চীন পান্ডা কূটনীতির অংশ হিসেবে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। পান্ডা প্রজনন কেন্দ্রের সূত্র অনুসারে চীন সরকার নির্দিষ্ট সমঝোতার মাধ্যমে অন্যান্য দেশে পান্ডা ভাড়া দিয়ে থাকে। তবে এজন্য চীনা বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় আয়োজক দেশগুলিকে পান্ডাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাগুলি প্রদান করতে হয়ে। এক্ষেত্রে প্রায়ই আয়োজক দেশগুলি পান্ডাদের রক্ষণাবেক্ষণের সাথে সম্পর্কিত ব্যয় বহন করে থাকে। এসব ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে তাদের যত্ন, আবাসস্থল নির্মাণ এবং খাদ্যতালিকাগত চাহিদাপূরণ।
এই কূটনীতির মাধ্যমে বিদেশে পান্ডাদের উপস্থিতি কেবল দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করে না বরং আয়োজক দেশগুলিতে পর্যটন, শিক্ষা এবং বাণিজ্যকেও উদ্দীপিত করে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। চীনের এই উদ্যোগের মাধ্যমে পান্ডারা বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রদূত হয়ে উঠেছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে পারস্পরিক দুই দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্ক স্থাপন করছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং আবাসস্থল ধ্বংসের সাথে বিশ্ব যখন লড়াই করছে, তখন চেংদু পান্ডা প্রজনন কেন্দ্রের সাফল্য সংরক্ষণের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।
সায়মা ইসলাম