
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ
লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা দুর্গম চরাঞ্চল এখন যেন এক ভয়াল অভিশাপের নাম। একদিকে কৃষকদের দীর্ঘ পরিশ্রমে ফলানো কোটি টাকার সয়াবিন, অন্যদিকে সংঘবদ্ধ জলদস্যু ও ভূমিদস্যুদের সশস্ত্র দখলদারিত্ব। এ যেন রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো ও কৃষকের রক্ত-ঘামে অর্জিত জীবিকার বিরুদ্ধে সরাসরি এক যুদ্ধ।
চর কচ্ছিয়া ও চর কানিবগায় প্রায় ৩০ জন কৃষকের ১২০০ একর জমির সয়াবিন জোরপূর্বক লুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসীরা চরে মহড়া দিয়ে, লাল পতাকা উড়িয়ে ভয়ভীতি ছড়িয়ে কৃষকদের চাষাবাদকৃত জমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করছে। চাষীরা জানান, তাদের সয়াবিন তোলার চেষ্টা করলেই হামলার শিকার হতে হচ্ছে, এমনকি মারধর ও প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
গত ১৩ এপ্রিল রায়পুরের বামনী ইউনিয়নের সাগরদী গ্রামের কামরুল হোসেন বাদী হয়ে ৫৪ জনের বিরুদ্ধে রায়পুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযুক্তরা নিজেরা বিএনপির কর্মী হিসেবে পরিচয় দিলেও এই দস্যুবাহিনীর প্রকৃত পরিচয় এখনো অজানা। তারা ভোলা ও মেহেন্দিগঞ্জ থেকে আগত বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, সন্ত্রাসীরা প্রতি কৃষকের কাছে ৪-৫ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করছে। চাঁদা না দিলে ফসল লুট করে নেয়া হচ্ছে। অভিযুক্তদের মধ্যে সাহাবুদ্দিন লস্কর, ছলেমান, জাকির বেপারি, দেলু প্রধানিয়া, ইসমাইল বেপারী ও মোতালেব বেপারীর নাম উঠে এসেছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু সালেহ মিন্টু ফরায়েজি বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে এই এলাকায় হত্যাকাণ্ড, হাত-পা কেটে দেওয়া, লুটপাট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখন কৃষকদের সয়াবিন তুলতে দিলেও সঙ্গে সঙ্গেই বাহিনী এসে সব কেড়ে নিচ্ছে। আমি প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাই, যেন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।”
চর কচ্ছিয়ার জমি দখল নিয়ে ইতোমধ্যে দুটি দেওয়ানি মামলা চলমান রয়েছে (মৌজা- কানিবগারচর, জেএল নং-৫১)। দাগ নং ১০০১ থেকে ৩০০২ পর্যন্ত প্রায় ১১৬৮.৭০ একর জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। উত্তরে ঘাসিয়া, পূর্ব ও দক্ষিণে কচ্ছিয়ার চর এবং পশ্চিমে নতুন জেগে ওঠা চর এই এলাকায় সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু।
রায়পুর থানার ওসি নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, “৫৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। আমরা তদন্ত করছি এবং প্রয়োজনীয় অভিযান চালিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনব।”
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর চর দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে বিএনপি-আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ নেতা আলতাফ মাস্টারের দখলে থাকা এই চর সম্প্রতি আবারও নতুন করে দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। গত ডিসেম্বরে মাছঘাট, বাজার ও জমি দখলকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হয়, বহু ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট হয়।
চাষীরা আজ তাদের জীবিকার জন্য জীবন হাতে নিয়ে সংগ্রাম করছেন। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক মদদে গড়ে ওঠা এসব সন্ত্রাসী চক্র শুধু কৃষক নয়, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আইনের শাসনের ওপর সরাসরি আঘাত হানছে। সময় এসেছে এই চরাঞ্চলের দিকে সরকারের কঠোর নজর দেওয়ার, যেন কৃষকের ঘামে ভেজা মাটি আর কোনো আগ্রাসী শক্তির পদচারণায় পিষ্ট না হয়।
ফারুক