ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

এক কুয়ায় দুই ভায়রার মৃত্যু ‘পোলাপান নিয়া অহন ক্যামনে সংসার চালামু?’

আর এম সেলিম শাহী, ঝিনাইগাতী, শেরপুর।

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

এক কুয়ায় দুই ভায়রার মৃত্যু ‘পোলাপান নিয়া অহন ক্যামনে সংসার চালামু?’

‘ছোট বোনের জামাই নিরঞ্জনকে কুয়া বানাবার কাজে সাহায্য করনের লাইগ্যা আমার স্বামী (নারায়ণ) শালচূড়া ভূঁইয়াবাড়িতে গেছিল। যাওয়ার আগে বইলা গেছিল, কুয়ার কাজ শ্যাষ কইরা বাজার কইরা বাড়িতে আইবো। আমার স্বামী বাড়িতে ঠিকই আইলো, লাশ হইয়া। আমার স্বামীর দিনমজুরির সামান্য আয় দিয়া আমগর সংসার চলত। বাড়িঘর, জায়গাজমি কিছুই নাই। বাবার বাড়িতে থাকি। পোলাপান নিয়া অহন ক্যামনে সংসার চালামু?’

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় কুয়া সংস্কার করতে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাওয়া নারায়ণ কোচের সদ্য বিধবা স্ত্রী জয়ন্তী কোচ (৩৫) এভাবে আহাজারি করছিলেন। গতকাল সোমবার বিকেলে উপজেলার রাংটিয়া গ্রামে তাঁদের বাড়ি। এই দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে।

গত রোববার বিকেলে ঝিনাইগাতীর শালচূড়া ভূঁইয়াবাড়ি এলাকায় কুয়া সংস্কার করতে গিয়ে দুই ভায়রার মৃত্যু হয়। এই দুজন হলেন উপজেলার শালচূড়া ভূঁইয়াবাড়ি গ্রামের নিরঞ্জন কোচ (৩৫) ও রাংটিয়া গ্রামের নারায়ণ কোচ (৪১)। তাঁরা উপজেলার রাংটিয়া গ্রামের গণেন্দ্র কোচের দুই মেয়ের জামাতা।

নিরঞ্জনের বাড়িতে ঢুকে তাঁর সদ্য বিধবা স্ত্রী সান্ত্বনা কোচকে (২৫) কাঁদতে দেখা যায়। অর্পিতা কোচ নামে তাঁদের চার বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। সান্ত্বনা কোচ বলেন, বাড়িতে বিশুদ্ধ পানির সংকট। সেই ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর স্বামী বাড়িতে কুয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। চার দিন পরিশ্রম করে মাটি খুঁড়ে কয়েকটি রিং বসিয়েছিলেন।

এরপর ওপরে টিনের চালের ঢাকনা দিয়ে কুয়ার মুখটি বন্ধ করে রেখেছিলেন। রোববার বিকেলে কুয়াটি সংস্কার ও ভেতরের পানি পরিষ্কার করার জন্য প্রথমে নারায়ণ কুয়ার ভেতরে নামেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর স্বামীও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। দুজনই মারা যান।

সান্ত্বনা কোচের স্বামী নিরঞ্জন ঝিনাইগাতী বাজারের একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে প্যাথলজিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। পাশাপাশি নিজের সামান্য কৃষিজমির দেখাশোনা করতেন। সীমিত আয় দিয়ে তাঁদের সংসার চলত। স্বামীর মৃত্যুর পর কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে তিনি চরম দুশ্চিন্তায় আছেন।

নারায়ণ ও নিরঞ্জনের বৃদ্ধ শ্বশুর গণেন্দ্র কোচ কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমারই তো এখন মরার কথা। আমার চোখের সামনে আমার দুই মেয়ে বিধবা হলো। সাদা কাপড় পরেছে, দেখতে কষ্ট লাগে।’

বাংলাদেশ কোচ আদিবাসী ইউনিয়ন শেরপুর জেলা শাখার সভাপতি রুয়েল কোচ বলেন, দুটি পরিবারই আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তার ওপর দুই বোন তাঁদের উপার্জনক্ষম স্বামী হারিয়ে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছেন। এ দুটি পরিবারের চলার জন্য সরকারিভাবে অর্থসহায়তা প্রয়োজন।

ঝিনাইগাতীর নলকুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রুকুনুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঘটনা জানার পর তিনি পরিবার দুটির পাশে দাঁড়িয়েছেন। সদ্য বিধবা দুই বোনকে আগামী দুই বছরের জন্য প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী অর্থবছরে তাঁদের একটি নলকূপ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রিফাত

×