
লাল লাল ভবন আর ভবন। বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ বরনে যেন আরও রঙিন হয়ে ফুটে উঠেছে রেডসিটি খ্যাত উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর রেলের শহর সৈয়দপুর। এ যেন ব্রিটিশ কলোনিয়ান লাল লাল ভবনের স্মারক। খ্রিষ্ট ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসাবে আজও জৌলসতা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই শহরের লাল লাল দুটি ক্যাথলিক গির্জা। সেই সাথে রয়েছে রেলকারখানার ও অফির্সাস ভবন ও বেশ কিছু ইন্সটিটিউট সহ অন্যান্য লাল ভবনের ছড়াছড়ি। ইতিহাস বলছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সৈয়দপুরে সর্বপ্রথম ও প্রাচীনতম লাল রঙ এর রোমান ক্যাথলিক গির্জাটি অবস্থিত। দুর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজের মাঝে লাল রঙের অনণ্যা দুটি স্থাপনা। আজও বিভিন্ন এলাকার মানুষ ব্রিটিশ এ দুটি স্থাপনা দেখতে আসে। ভেতরের নৈসর্গিক পরিবেশ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে সহজেই সৃষ্টিকর্তার প্রতি একাগ্রতা বৃদ্ধি করে। তবে ব্রিটিশ ঐতিহ্যের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এখনো কিছু থাকলেও বেশির ভাগই নষ্টের উপক্রম।
জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে স্থাপিত হলে সৈয়দপুরের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। রেলওয়ে ষ্টেশনের ঠিক উত্তর পাশেই একটি ছোট লোকোশেড স্থাপন করা হয় এবং লোকোশেডকে ঘিরে প্রায় ১১০ একর জায়গা জুড়ে রেলওয়ে কারখানা গড়ে তোলা হয়। রেলওয়ে কারখানায় বাঙ্গালী ও বিহারীদের পাশাপাশি রোমান ক্যাথোলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কাজ করতো। কর্মরত খ্রিষ্টানদের উপাসনার জন্য ব্রিটিশ সরকার সাহেব পাড়ার দুইপ্রান্তে রোমান ও ইউরোপীয় স্থাপত্য কলার সমন্বয়ে দুইটি গির্জা নির্মাণ করেন। রেলওয়ে কারখানার গেট সংলগ্ন গির্জাটি যিশু খ্রিষ্টের মাতা মেরি (মারিয়ামের) নামে উৎসর্গ করা হয়।
১৮৯২ সালে ব্রিটিশ সরকার গির্জার পাশে রেলওয়ের ৩ বিঘা জমির উপর পুরোহিত ভবনও স্থাপন করেছিল। দূর দূরান্ত থেকে অনেকে প্রাচীন শিল্প কলায় সমৃদ্ধ এই গির্জা দুটি দেখতে আসেন।প্রায় ১৩৫ বছরের ব্রিটিশ ঐতিহ্যের স্বার বহন করছে। ভেতরের দামি কাঠের তৈরি নান্দনিক শিল্পকর্ম চোখ ধাধিয়ে দেয়।ক্রাইস্ট চার্চের তদানীন্তন ব্রিটিশ আমলে রেলওয়ে কারখানা নির্মাণের সুবাদেই পাশাপাশি এ দুটি চার্চ গড়ে উঠে সৈয়দপুরে।এ সম্প্রদায়ের প্রবীণ সদস্য প্রভাষ বিশ্বাসের ভাষ্যমতে, রেলওয়ে কারখানায় কর্মরত ব্রিটিশ খ্রিষ্ট ধর্মের মানুষের প্রার্থনার জন্যই একই ধর্মের দুই অনুসারীদের জন্য নির্মাণ করা হয় পৃথক পৃথক দুটি চার্চ। রোমান ক্যাথলিক চার্চটি ৪০ শতক ও প্রটেস্টান্ট চার্চটি ৪৫ শতক জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।এই ধর্মের পরিবারগুলোর বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয় এ শহরে সাব-অর্ডিনেট কলোনি, সাহেবপাড়া ও অফিসার্স কলোনি অন্যতম।এই নামের কলোনীগুলো আজ সৈয়দপুর শহরে রয়েছে। কিন্তু সেই পরিবার গুলো নেই।সৈয়দপুর শহরের নতুন বাবুপাড়ার স্থানীয় এক শিক্ষক নন্দিনী মল্লিক।তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সৈয়দপুরে বসবাসকারী ইংরেজ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বেশির ভাগ ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে গেলেও কিছুসংখ্যক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এ শহরে থেকে যান। তবে ঢাকা,মানিকগঞ্জ, বরিশাল, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলার বাঙালি ও অন্যান্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ রেলওয়েতে চাকরি করতে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। চার্চ দুটির সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বিশ্বাস ও নিকোলাশ গমেজ বলেন,প্রতিনিয়ত সৈয়দপুরে খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যে সামান্য এই সম্প্রদায়ের লোকজন আছেন মূলত তাদের পরিবারের সদস্যদের দেয়া আর্থিক সহযোগিতায় বর্তমানে এই চার্চ দুটির দেখাশোনা করা হয়। ব্রিটিশ আমলের নন্দনিক আর্থিক শিল্পকর্ম আছে তা এই সামান্য অর্থ দিয়ে সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্রিটিশ এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
ক্রাইস্টচার্চের পুরোহিত রেভারেন্ড মার্টিন হীরা মন্ডল বলেন, ব্রিটিশ ঐতিহ্যের স্বার নান্দনিক স্থাপনার এই চার্চ দুটি এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। নিয়মানুযায়ী এখনো চার্চ দুটিতে উপাসনার কাজ অব্যাহত থাকলেও চার্চ দুটি রক্ষনাবেক্ষনে আমাদের আর্থিক স্বল্পতা রয়েছে। ব্রিটিশ এই স্থাপত্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সংস্কৃতি ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। সৈয়দপুরের অল্প সংখ্যক খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর আকুল আবেদন ধর্মীয় এই প্রতিষ্ঠান দুটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকার যেন এগিয়ে আসে।
সৈয়দপুরের বিশিষ্ট সমাজসেবক প্রভাষক শওকত হায়াৎ শাহ্ বলেন, এখানে আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই মিলেমিশে থাকি এবং একে অপরের আপনজন হিসাবেই প্রজন্মে পর প্রজন্ম যেন এক সাথে থাকতে পারেন।
এদিকে রেলওয়ের পূর্ত বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের প্রধান রেল কারখানাটি সৈয়দপুরে গড়ে ওঠে। কিন্তু এর আগেই এ শহরের সয়েল টেস্ট করেন ব্রিটিশরা। সম্ভাব্যতা যাচাই হয় দীর্ঘসময় ধরে। এরপর তারা নিশ্চিতও হন ভৌগোলিক সুবিধাজনক সৈয়দপুর শহরেই গড়ে তোলা হবে রেলওয়ে কারখানা। সমুদ্র সমতল থেকে ১৯০ ফুট উচ্চতায় সৈয়দপুরের অবস্থান। কেবল রেল কারখানা হলে তো চলবে না? এজন্য প্রয়োজন একটি নগর পরিকল্পনা। পরে ব্রিটিশরা শুরু করে সৈয়দপুর নগর তৈরির কাজ। ওই সময় রংপুরের জমিদারের কাছ থেকে সৈয়দপুরে রেলওয়ে স্থাপনা গড়তে মাত্র পাঁচ সিকায় (১২৫ পয়সা) চান্দিনার শর্তে কিনে নেওয়া হয় সাড়ে ৮০০ একর জমি। এর মধ্যে ১১০ একর জমিতে তৈরি হয় বিশাল রেলওয়ে কারখানা। ১৮ একর জমিতে গড়া হয় রেলওয়ে সেতু কারখানা। আর মালামাল যোগান দেওয়ার জন্য ৬৮ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় সরঞ্জাম গুদাম (স্টোর ডিপো)। ব্রিটিশ নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী গোটা শহরটিতে তৈরি হয় কংক্রিটের পাকা সড়ক। তৈরি হয় স্ট্রিট লাইট, যা তেল দিয়ে জ্বালানো হতো। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের জন্য পরিপাটি অফিসার্স কলোনি গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে রেল কারখানার ফোরম্যান ও চার্জ ম্যানদের জন্য সাহেবপাড়া, খালাসিদের (শ্রমিক) জন্য খালাসি মহল্লা, করনিকদের জন্য মুন্সিপাড়া, মিস্ত্রিদের জন্য মিস্ত্রীপাড়া, বাবুদের জন্য বাবুপাড়া, নীচু কলোনি, উঁচু কলোনি, হাতিখানা ইত্যাদি নামে পাড়া গড়ে ওঠে তখন। এছাড়াও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য গড়ে ওঠে সুইপার কলোনি।রেলওয়েতে কর্মরতদের গড়ে তোলা হয় একটি রেলওয়ে হাসপাতাল, বিনোদনের জন্য কাব মিলনায়তন, প্রার্থনার জন্য দুটি গির্জাও স্থাপন করা হয়।
রংপুর গবেষণা পরিষদ নীলফামারী জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, ব্রিটিশ আমলের হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ এদেশের মানুষকে ভয় দেখাতেন। গড়বড় করলে লাল ঘর দেখাবো (অপরাধ করলে জেলের ভাত খাওয়াবো)। তখন থেকে লালঘর ভীতি এই জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ আমলে থানা, জেলখানা, রেলস্টেশন, সরকারি অফিস, হাসপাতাল, টেলিগ্রাফ অফিস, বাংলো প্রভৃতির রং ছিল লাল। সৈয়দপুর শহরটি এখনও তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই শহরের অধিকাংশ বাড়িঘর লাল। বিশেষ করে রেল ও সরকারি স্থাপনার।
দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্তাবধায়ক (ডিএস) অফিস ও বাংলো দুটোই লাল। এসব ব্রিটিশদের স্মারক। রেলের প্রায় সব ভবনই লাল। এ ছাড়া শতবছরের ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর শিল্প সাহিত্য সংসদ। ১৮৮২ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিনোদনের জন্য দুটি মঞ্চ তৈরি হয়। একটির নাম মূর্তজা ইন্সটিটিউট (ইউরোপিয়ান ক্লাব) ও অপরটি ফিদা আলী ইন্সটিউট (ব্যাক পাইপার)।
রেলওয়ে পূর্ত বিভাগের মতে সৈয়দপুর শহরে ২৪০০ রেলওয়ে কোয়ার্টার রয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি অফিসার্স বাংলো। যার সবগুলোই লাল। এমনকি ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত রেলওয়ে অফিসার্স কাবটিও লাল রঙের। বিশ্ব ঐতিহ্য পরিব্রাজক এলিজা বিনতে এলাহি সৈয়দপুরের লাল ভবনগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি অসংখ্যবার সৈয়দপুর ভ্রমণ করেছেন। এলিজা বলেন, ভারতের রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরকে পিংক সিটি বা গোলাপি শহর বলা হয়। ১৮৭৬ সালে ব্রিটেনের রানি জয়পুর সফরে আসেন। তখন রাজা রাম সিংহ গোলাপি রং দিয়ে গোটা জয়পুর সাজিয়ে তোলেন। এলিজা আরও বলেন, আমার দৃষ্টিতেও সৈয়দপুর লাল লাল বিল্ডিংয়ের শহর। অসম্ভব সুন্দর শহর এটি।
শহরটি পর্যটন খাতে নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে। কেননা এই শহরে রয়েছে রেল,সড়ক ও আকাশ পথে সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা।
রাজু