
.
শুকনা মৌসুমে স্রোতধারায় পানি প্রবাহে সৈয়দপুর কমান্ড এলাকায় ক্যানেলগুলো যেন নবযৌবন পেয়েছে। প্রবাহিত পানি দ্বারা সংলগ্ন কৃষিক্ষেতে সবুজের সমারোহের পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিসহ তিস্তার সেচ পানিতে ব্যাপক সাশ্রয় হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।
জানা যায়, বেগম খালেদা জিয়া সরকার ১৯৯১ সালে এ অঞ্চলে কৃষকদের স্বার্থে তিস্তা সেচ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। শুধু সৈয়দপুর পানি উন্নয়ন বিভাগের আওতায় ৮০ হাজার একর জমিতে চাষাবাদের জন্য নীলফামারী, সৈয়দপুর, রংপুর, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, খানসামা, কিশোরগঞ্জ, তারাগঞ্জ এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়েছে এ সকল খাল। দিনাজপুর, বগুড়া ও রংপুর নামে প্রধান তিন খাল খনন করা হয়। এই খাল থেকে সেকেন্ডারি ও টারশিয়াীি খাল খনন করে কৃষিজমির ভেতর দিয়ে সম্প্রসারণ করা হয়। বিএনপি সরকারের মেয়াদকালে ওই সকল খালদ্বারা তিস্তার সেচ পানি পেয়ে চাষাবাদে ব্যাপক লাভবান হন কৃষকরা। ক্ষমতার পালা বদলে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে কৃষকদের। পরবর্তী সরকার দীর্ঘদিন খালগুলো সংস্কার না করায় মিশে যায় মাটির সঙ্গে। এতে গভীর বা অগভীর নলকূপের ওপর নির্ভর করতে হয় কৃষকদের। এতে ব্যয় বৃদ্ধির ফাঁদে পড়ে কৃষক। তিস্তার সেচ পানির চেয়ে ডিজেল বা বিদ্যুৎ চালিত পাম্পে তিনগুণ বেশি ব্যয়ে চাষাবাদ করতে হয়। পানিসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগ্রহ হারান কৃষক। এতে কমতে থাকে চাষাবাদ। খা খা বালুচরে নদীবেষ্টিত জমি পরিণত হয় মরুভূমিতে। মঙ্গা নামক নীরব দুর্ভিক্ষ বিরাজ করে উত্তরের জনপদগুলোতে। পরে আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার ক্যানেলগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এতে তিস্তা সেচ ব্যবস্থাপনায় প্রাণ সঞ্চারিত হয় কৃষিতে। সৈয়দপুর পানি উন্নয়ন বিভাগের অধীনে আওতাভুক্ত কমান্ড এলাকার ৪৭ হাজার ১৩৯ হেক্টর জমির মধ্যে ৪৫ হাজার ৫ শত হেক্টর কৃষিজমি চাষাবাদের লক্ষ্যে সম্প্রসারণ ও পুনর্বাসন কাজ করা হয়। ২০২৪ সাল থেকে তিস্তা খালের পানি সহজে পাওয়ায় বদলে যায় এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি। এতে ধারাবাহিকভাবে সেচ ক্যানেলের আওতায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হওয়ায় ২ লাখ টন খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধ পায়। প্রতিবছর শুধু সেচ পানি ব্যবহারে কৃষকদের সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ২০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
সৈয়দপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, এ বিভাগের আওতায় দিনাজপুর খাল থেকে সেকেন্ডারি ৯ ও সরাসরি ৪ টি এবং ২৫ টারশিয়ারি খাল সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এর পানিতে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদ করা যাবে। প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় নিতে রংপুর খালের ২টি সেকেন্ডারি, ৫ টি টারশিয়ারি খাল খনন করা হয়েছে। একইভাবে ৬ হাজার হেক্টর জমি সেচ প্রদানে বগুড়া খালে ৩ টি সেকেন্ডারি, সরাসরি ৩ টি ও ২টি টারশিয়ারি খাল খনন করা হয়েছে। এতে জমির উর্বরতা, ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার বৃদ্ধি, রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে এসেছে। এতে সামগ্রিকভাবে জলজ ইকোসিস্টেমের উন্নতি ঘটেছে। যার প্রভাব পড়েছে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যে ও ক্যানেল সংলগ্ন এলাকাবাসীর।
দেখা যায়, বিভাগের আওতায় প্রধান খাল থেকে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি খাল থেকে স্রোতধারায় সেচ পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কৃষকরা ইরি-বোরো ক্ষেতে নালা কেটে এ সেচ পানি নিচ্ছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ ও কৃষাণীরাও ব্যস্ত এখন সেচ পানি নিতে। চৈত্রের তাপপ্রবাহে জুড়াতে অনেক ক্যানেলে শিশুরা সাঁতার কাটছে। যেন চাষাবাদের মহোৎসব লেগেছে তিস্তা সেচ ক্যানেল এলাকায়।
নীলফামারী,খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া দিনাজপুর খালের সেচ পাওয়া উপকারভোগী কৃষক আবুল হোসেন বলেন, আগে খাল ছিল, পানি ছিল না। বর্তমান সরকারের আমলে স্রোতের গতিতে পানি আসছে। এ পানি সেকেন্ডারি থেকে টারশিয়ারি খালের মাধ্যমে একরপ্রতি ৪০০ টাকা জমা দিয়ে সারাবছর চাষাবাদ করছি।
শ্বাষকান্দর এলাকার জমির উদ্দিন নামে কৃষক বলেন, নলকূপ ব্যবসায়ীদের একরপ্রতি ৬ হাজার টাকা দিতে হতো। এরপর মিলত সেচ পানি। এতে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ব্যয় হতো চাষাবাদে। এবার ইনশাল্লাহ হবে না। কারণ নামমাত্র দামে পাচ্ছি সেচের পানি।
সৈয়দপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, এই সেচ পানির ব্যবস্থাপনা মূলত কৃষি বেষ্টিত মানুষের জন্য। এর পানি নামমাত্র মূল্যে কৃষকদের প্রদান করা হচ্ছে। এতে মাটির উর্বতা শক্তি বৃদ্ধিতে সমগ্র ফসলসহ উদ্ভিদ ও জীবের উপকার হবে। সর্বোপরি এই ক্যানেলে পানি সরবরাহ থাকলে কল্যাণ বয়ে আনবে। দৃশ্যপট বদলে যাবে অর্থনীতির।