
ছবি: সংগৃহীত
খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে ত্রিপুরাদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসু। রীতি অনুযায়ী সকালে দেবী গঙ্গার উদ্দেশ্যে ফুল ও হাতে বোনা নতুন কাপড় ভাসিয়ে হারি বৈসু উদযাপন করে তারা। এর মধ্য দিয়ে পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরকে বরণের প্রস্তুতি নেয় তারা। বৈসু উৎসব চলবে আগামী তিন দিন।
অপরদিকে আজ চাকমা জনগোষ্ঠীর বিজু উৎসবের দ্বিতীয় দিন। অর্থ্যাৎ মূল বিজু। এই দিন ঘরে ঘরে চলে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। পরিবেশন করা হয় প্রায় ১ শত রকমের সবজি দিয়ে তৈরি বিশেষ পাঁজন। সারাদিন চাকমাদের ঘরে ঘরে চলে অতিথি আপ্যায়ন ও ঘুরে বেড়ানো। মূল বিজুতে প্রধান আকর্ষণ থাকে পাঁজন তরকারি যা কমপক্ষে ৩২ প্রকার সবজি মিক্স করে রান্না করা হয়। অনেকে শতের অধীক সবজি মিক্স করে রান্না করেন এই পাঁজন। পাহাড়ী জনগোষ্ঠি মনে করে, এটি যেহেতু বিভিন্ন প্রকার সবজি মিক্স করে রান্না করা সেহেতু এটি ঔষধি গুনসমৃদ্ধ একটি তরকারি। পাচন ছাড়া প্রতিটি ঘরে ঘরে থাকে নানান ধরনের খাবার আইটেম।
এইদিনে সাধারণত কাউকে নিমন্ত্রণ করতে হয় না। যে কেউ যে কোনো ঘরে গিয়ে বিজু খেতে পারেন। অপরিচিত কেউ এলে থাকে স্বসম্মানে আপ্যায়ন করা হয়।
পাহাড়ের বিজু এখন একটি সার্বজনীন উৎসব। এখানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠির পাশাপাশি বাঙ্গালিরাও বেড়াতে যায় তাদের বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে। এ দিন চলে শুধু অতিথি আপ্যায়ন ঘুরাফেরা আর আনন্দ উৎসব। সকালের দিকে চলে রান্নাবান্নার কাজ। রান্না শেষ করে অপেক্ষায় থাকেন কখন অতিথি আসবেন।
চৈত্রের ভোরের প্রথম আলোয় দেবী গঙ্গার উদ্দ্যেশে ফুল ভাসানোর জন্য জড়ো হয় ত্রিপুরা নারীরা। রবিবার সকালে খাগড়াছড়ির খাগড়াপুর এলাকায় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক রিনা-রিসাই পরে তারা অংশ নেয় এই উৎসবে। বন থেকে সংগ্রহ করা মাধবীলতা,অলকানন্দ,জবাসহ বিভিন্ন ধরেন ফুল দিয়ে পুরাতন বছরের দুঃখ গ্লানি মুছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে দেবী গঙ্গার উদ্যোশ পূজা করেন তারা। এসময় নিজেরদের হাতে বোনা ছোট্ট কাপড় ভাসানো হয় জলে।
ত্রিপুরা পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্রের মাসের ২৯ তারিখে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। ফুল ভাসানোর ঐ উৎসবের অংশ নিতে পেরে খুশি ত্রিপুরা নারীরা।
হারি বৈসুতে অংশ নেয়া রীতি ত্রিপুরা ও তুলিকা ত্রিপুরা বলেন ,‘ আমরা খুব সকালে ফুল সংগ্রহ করি। পরে সেই ফুল আমরা নদীতে এসে ভাসিয়ে দিই। এসময় জলে গঙ্গা দেবীর পুজা করি। এখানে অংশ নিতে পেরে আমরা খুবই খুশি। কারণ বছরে মাত্র একবারই এই ধরনের উৎসব হয়।’
উৎসবে অংশ নেয়া গায়ত্রী ত্রিপুরা বলেন, ‘আমি ঢাকায় থাকি। অনেক বছর পর আমি এ ধরনের উৎসবে অংশ নিয়েছি। খুবই ভালো লাগছে হারি বৈসু’র এই উৎসবে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে’।
নতুন বছর বরণে হারি বৈসু, বৈসুমা, বিসিকাতাল তিন দিন পৃথক আয়োজন করে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী। হারি বৈসুতে তারা জলে ফুল ও নতুন কাপড় ভাসায়। এছাড়া বৈসুমাতে ঘরে ঘরে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। বিসিকাতালের দিন নতুন বছরকে বরণ করা হয়।
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের এই উৎসব দেখতে পর্যটকরাও যোগ দিয়েছে। এমন বর্ণিল আয়োজন দেখে মুগ্ধ তারা। ঢাকা থেকে আসা সাবরিনা জানান,‘ আমি প্রথম এমন সুন্দর একটা আয়োজন দেখেছি। খুবই ভালো লাগছে পাহাড়ের মানুষের প্রাণ এই উৎসব দেখে। পাহাড়ের মানুষ সবসময়ই এমন ভালো থাকুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা’।
বৈসু উদযাপন কমিটির সদস্য দীনা ত্রিপুরা জানান, ‘মূলত নারীদের অংশগ্রহণের নতুন বছর বরণের এই হারি বৈসু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরা নারীদের অনেকেই রিনা রিসাই (নিজেদের এতিহ্যবাহী পোশাক) বুনন করে। নতুন বছরে পোশাক বুননে যাতে দক্ষতা আরো নৈপুণ্য় আসে সেজন্যই ফুলের সাথে ভাসানো হয় হাতের বোনা ছোট্ট কাপড়। তাদের বিশ্বাস, এতে গঙ্গা দেবীর আর্শীবাদে বুননকাজে তারা আরো দক্ষ হয়ে উঠবে। ১৫ এপ্রিল শেষ হবে ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসব।
মায়মুনা