
তিস্তা নদী বেষ্টিত জেগে ওঠা চরাঞ্চলের জমিতে নিরাপদ মিষ্টি কুমড়াসহ নানা জাতের সবজি চাষ করে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। চরের চাষীরা বলছেন, "চরের আবাদ হামার ভাগ্য বদলে দিছে।"
যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ, যেন তিস্তার চরের ফসলের হাসি। চরের ধু ধু বালু চর এখন সবুজে ঢেকে গেছে। এ বালু চরে চাষাবাদ হচ্ছে ভুট্টা, আমনধান, মিষ্টি কুমড়া, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, বরবটি, মিষ্টি আলু, বাদাম, করলা, বেগুন, পুঁই শাক, লাউ শাকসহ বিভিন্ন রবি শস্য। এসব শস্য চাষে রঙিন স্বপ্ন দেখছেন তিস্তা পাড়ের কৃষক। প্রায় প্রতিটি ফসলের ভালো ফলন হওয়ায় বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত কৃষকরা।
চোখ আটকে যায় চরের বিস্তর মিষ্টি কুমড়া আর ভুট্টার ক্ষেত। দেশের ভুট্টার ব্র্যান্ডিং জেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে লালমনিরহাট। দুই-তিন বছর আগে এটি ছিল না। মিষ্টি কুমড়া চাষে ফেরোমন ফাঁদসহ খরচবিহীন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন কৃষকরা। এতে পোকা-মাকড়ের উৎপাত কমেছে।
সরেজমিনে উপজেলার তিস্তা নদী বেষ্টিত চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে বালু চরে শোভা পাচ্ছে মিষ্টি কুমড়াসহ নানা জাতের শস্য। এসব চরের চাষীরা আলু, গম, বাদাম, সরিষা, রসুন, পিয়াজের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে মিষ্টি কুমড়া চাষ করেছেন। তিস্তার চরাঞ্চলে পলি ও উর্বর দো-আঁশ মাটিতে মিষ্টি কুমড়ার বাম্পার ফলন ও অধিক দাম পাওয়ার আশাও করছেন চাষীরা।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, তিস্তা নদী উত্তরের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা সহ ৫টি জেলা দিয়ে প্রবাহিত। প্রতিটি জেলায় তিস্তা নদীতে জেগে ওঠা চরের আয়তন ক্রমাগত বাড়ছে। এতে নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমলেও চরগুলোতে চাষাবাদ বেড়েছে। চলতি মৌসুমেই আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ হেক্টর। এবার নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা বিভিন্ন চরে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে রবি শস্য চাষে কোমর বেঁধে নেমেছেন কৃষকরা। তাই যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। শুধু চরের জমিতে নয়, চরে বসবাসরত অনেক পরিবার বাসভূমিতে জাঙ্গি তৈরী করে সেখানেও সবজি চাষ করছেন।
ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি তেলিপাড়া এলাকার বিধা শরিফা বেওয়া (৫০) বলেন, "তিস্তা নদী হামার গুলার জমি-জিরাত, বাড়ি-ভিটা সউগ নিছে। এলা নদীর ভাসা চরত কৃষি অফিসের বুদ্ধি শুনিয়া কাশিয়াবাড়ি চোটেয়া মিষ্টি কুমড়া, আলু, গম, বাদাম, সরিষা, রসুন, পিয়াজ আবাদ করি লাভ পাবার নাগছি। চরের আবাদ হামার ভাগ্য বদলে দিছে।" একই অভিব্যক্তি স্থানীয় ইউপি সদস্য আশরাফুল ইসলাম, জীতেন্দ্র নাথ, তুহিন মিয়া, দুলাল হোসেনসহ অনেকেই। তারা বলছেন, চর এখন আর অভিশাপ নয়, হয়ে উঠেছে সবুজের আশীর্বাদ।
চরখড়িবাড়ি চরের কৃষক হামিদুল ইসলাম জানান, "ইতোমধ্যে গম উঠে গেছে। কিছু ভুট্টা উঠেছে। গম বিক্রি হচ্ছে ১৩৫০ টাকা মন এবং ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকা মন দরে। এবার দাম ভালো উঠেছে। কিন্তু চর থেকে হাটবাজারে পরিবহনে খরচ বেশী হচ্ছে। তারপরেও বেশ লাখ পাচ্ছি আমরা।"
ডিমলার ঝাড়সিংগশ্বর এলাকার কৃষক মামুন ইসলাম বলেন, "আগে তিস্তার চরাঞ্চল পতিত ছিল। অন্য ফসলের আশানুরূপ ফলন না হওয়ায় এসব জমিতে ফসল ফলানো হয়নি। এখন আধুনিক পদ্ধতিতে চরে নানামুখী রবি শস্য চাষ হচ্ছে। এতে ভালো ফলন এবং দামও পাওয়া যাচ্ছে।"
খালিশাচাঁপানী ডালিয়ার বাঘের চর, যা তিস্তা ব্যারাজ সংলগ্ন, এখানকার কৃষক আরিফ হোসেন বলেন, "মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা ও গমের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে এবার দানা ছোট।"
জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা এলাকার কৃষক বিমল চন্দ্র রায় জানান, "গত বছর মিষ্টি কুমড়ার দাম বেশি পাইনি। এবার আশা করছি ভালো দাম পাবো। আবহাওয়া ভালো থাকলে ফলন ভালো হবে। তিস্তা চরে আবাদ করে নদীপাড়ের মানুষের সংসার চলে। চাষাবাদের জন্য তেমন কোনো জমি নেই। তাই প্রতিবছর নদীতে চর জাগার অপোয় থাকি।"
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. এস এম আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, "তিস্তায় জেগে ওঠা চরে ব্যাপক চাষাবাদ হয়েছে ও হচ্ছে। তিস্তাপাড়ের কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি আমরা।"
আফরোজা