
বাংলা সনের ১৪৩২। সোমবার (১৪ এপ্রিল) নববর্ষের পহেলা বৈশাখ। উৎসব ঘিরে উত্তবঙ্গের বাহের দ্যাশ খ্যাত রংপুর অঞ্চলের বৈশাখ হয়ে উঠে বাঙালির জীবনে যুগ যুগান্তরের উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিনে নতুন বছরের শুভারম্ভের সাথে সাথে একত্রিত হয় বাঙালির হৃদয়ের উষ্ণতা, স্নেহের এবং সাম্প্রদায়িক ঐক্য। বৈশাখের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল বাঙালির আনা-র- বৈশাখী খাবার। প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসবে বাঙালির খাবারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে নানাবিধ সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা পহেলা বৈশাখের আনন্দকে আরও বর্ণময় করে তোলে। বৈশাখের খাবার কেবল মাত্র খাদ্য চাহিদাই মেটায় না, বরং বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বাঙালির বৈশাখী খাবারগুলোর তালিকা ঐতিহ্যবাহী এবং সমৃদ্ধ, যা পহেলা বৈশাখের আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। বৈশাখের সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় পান্থার সাথে ভর্তার প্রস্তুতি, যা এই উৎসবের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হিসেবে বিবেচিত। তবে অঞ্চলের বৈশাখের ইলিশ মাছের চাহিদা নেই বললেই চলে।
পান্থা ভাত-পান্থা ভাত পহেলা বৈশাখের একটি অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। এটি সাধারণত আগের দিনের ভাতকে পানিতে ভিজিয়ে রেখে তৈরি করা হয়। প্রাচীনকালে মাঠে কাজ করা কৃষকদের এই পান্থা ভাত ছিল এক ধরনের পুষ্টিকর এবং সহজে প্রাপ্য খাবার, যা তাদেরকে সারা দিন কাজ করার শক্তি দিতো। বৈশাখের সকালে পান্থ ভাতের সঙ্গে লবণ, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, সরিষার তেল পাটশাক ভাজি পরিবেশন করা হয়। এই খাবারের তাজা স্বাদ এবং সহজ প্রস্তুতি বৈশাখের উষ্ণ আবহাওয়ায় এক বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা বহন করে। এর সাথে লেবুর রস দিলে হয়ে উঠে আরও প্রাণবন্তো।
ভর্তা বৈশাখী খাবারের তালিকায় ভর্তা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বাঙালির বৈশাখী মেন্যুতে বিভিন্ন রকমের ভর্তা থাকে, যার মধ্যে সিঁদলভর্তা, শুটকিভর্তা, আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, টমেটো ভর্তা, ধোঁয়া মরিচ ভর্তা, ডালের ভর্তা অন্যতম। আলু ভর্তা তৈরি করা হয় সেদ্ধ আলু, সরিষার তেল, কাঁচা মরিচ এবং লবণ দিয়ে। বেগুন ভর্তা সাধারণত ভাজা বেগুন বা পোড়া বেগুন দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রতিটি ভর্তার স্বাদ ভিন্ন হলেও এগুলো বৈশাখী খাবারের আসরকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। সহজে তৈরি হওয়া এবং স্বাদে ভরপুর এই ভর্তাগুলো বৈশাখী উৎসবের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। আর সব থেকে মজাদার ঝালে ঝাল সিঁদল ভর্তা। এটি এ অঞ্চলের সব থেকে ঐতিহ্য বহন করছে। মুখরোচক খাবার সিঁদল। যে কোন মানুষকে এর ভর্তা স্বাদ পাগল করে দিবে। শুধু ভর্তা না। এ অঞ্চলে বলা হয়ে থাকে ছোট মাছের শুঁটকি ও কচুর ডাটা দিয়ে তৈরি করা এক প্রকারের খাবারের নাম সিঁদল। রংপুর অঞ্চলের ,নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার গ্রামবাংলার মুখরোচক খাবার হিসেবে এর কদর রয়েছে যথেষ্ট। সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বাদের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের এটি অতিপ্রিয় একটি খাবার।
নীলফামারীর একজন শ্রেষ্ঠ রাধুনী ফৌজিয়া ইয়াসমিন জলি জানান, রান্না করার সময় সিঁদল থেকে ছাই ফু দিয়ে তুলে পরিষ্কার করার পর ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়। সিঁদলের ভর্তা যেমন মজাদার তেমনি বিভিন্নভাবে সিঁদল রান্না করা যায়। মাগুর মাছ শাঠি মাছ বা কাতলা বা বোয়াল মাছের সাথে সিঁদল মিশিয়ে একটু বেশি ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়। শাক দিয়ে সিদল রান্নার প্রচলন সুপরিচিত হলেও জনপ্রিয় রান্নার পদ্ধতি হচ্ছে সিদল ভর্তা। নীলফামারীর লেখক ও সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা জানান, সিঁদল একটি সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার। এটি আমার বাড়িতে রাখা হয়। অন্তত মাসে ২-৩ বার সিঁদল দিয়ে তৈরি করা খাবার খাই। বৈশাখে এর কদর সব থেকে বেশী।
শাকসবজি- বৈশাখী টেবিলে শাকসবজির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে পাক শাক, লাউ, পুঁইশাক, ধোঁয়া শাক এবং নানা রকম সবজি দিয়ে রান্না করা শাকের পদ বৈশাখী মেন্যুকে পুষ্টিকর করে তোলে। সবজির সহজ প্রাপ্যতা এবং পুষ্টিগুণ এই খাবারগুলোকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। বৈশাখী খাদ্যতালিকায় শাকসবজির উপস্থিতি প্রাকৃতিক এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের প্রমাণস্বরূপ।
লাবড়া- লাবড়া হচ্ছে মিশ্রিত সবজির একটি তরকারি, যা বৈশাখী উৎসবে জনপ্রিয় একটি পদ। এটি মূলত বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি যেমন লাউ, মিষ্টি কুমড়ো, পটল, আলু, শিম, বেগুন ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরি করা হয়। লাবড়া সাধারণত খিচুড়ির সঙ্গে পরিবেশন করা হয় এবং বৈশাখী টেবিলে এর উপস্থিতি রুচি এবং পুষ্টি দুইই বাড়িয়ে তোলে। লাবড়ার হালকা মশলা এবং মিশ্রিত সবজির স্বাদ বৈশাখী খাদ্যতালিকায় নতুনত্ব যোগ করে।
চিড়া দই-বৈশাখী সকালে অনেকেই চিড়া এবং দই দিয়ে দিন শুরু করেন। চিড়া এবং দইয়ের মিশ্রণ বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি সহজ এবং পুষ্টিকর খাবার। চিড়ার সঙ্গে দই, গুড় এবং কাঁচা আম মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। এই খাবারের পুষ্টিগুণ এবং সহজ প্রস্তুতি বৈশাখের সকালে একটি প্রাসঙ্গিক এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
মুড়ি- মুড়কি মুড়ি এবং মুড়কি বাঙালির বৈশাখী খাবারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুড়ি একটি হালকা এবং হজমে সহজ খাবার, যা নানা ভর্তা, সবজি বা ডালের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হয়। এছাড়া মুড়কি যা গুড় দিয়ে খৈই মিশিয়ে তৈরি করা হয় একটি মিষ্টি খাবার হিসেবে বৈশাখী টেবিলে পরিবেশন করা হয়।
এই হালকা এবং রুচিকর খাবারগুলো বৈশাখী উৎসবের সময় বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
পিঠা-বৈশাখী উৎসবের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো পিঠা। বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে পিঠার স¤পর্ক গভীর। পহেলা বৈশাখে নানা রকমের পিঠা তৈরি করা হয়, যার মধ্যে পুলি পিঠা, দুধপুলি, পাটিসাপটা উল্লেখযোগ্য। চালের গুঁড়ো এবং নারকেল দিয়ে তৈরি এসব পিঠা মিষ্টি স্বাদের এবং বাঙালির হৃদয়ে নান্দনিক এক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। বিশেষ করে ভাপা পিঠা শীতের দিনগুলোতে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি বৈশাখের সময়ও এটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
মিষ্টান্ন:- বৈশাখী খাবারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মিষ্টান্ন। রসগোল্লা, সন্দেশ, মিষ্টি দই ইত্যাদি মিষ্টান্ন বৈশাখী উৎসবের খাদ্যতালিকায় অপরিহার্য। এগুলোর স্বাদ শুধু বাঙালির প্রিয় নয়, বরং এগুলো অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। রসগোল্লার নরম ও মিষ্টি স্বাদ, সন্দেশের শীতল অনুভূতি, আর দইয়ের প্রাকৃতিক মিষ্টিত্ব এসব মিষ্টান্ন বাঙালির উৎসবের সময় বাড়ির পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
সবশেষে বলা যায়, বাহের দ্যাশের বাঙালির বৈশাখী খাবার আমাদের দেশীয় জীবনযাত্রার একটি প্রতিফলন। এটি কেবলমাত্র বাঙালি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, এটি সামাজিক বন্ধন এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর রূপান্তরিত এক মূল্যবান ঐতিহ্য। বৈশাখী উৎসবের খাবারগুলো কেবলমাত্র মুখের স্বাদ বা পুষ্টি নয়, বাঙালির সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার একটি মাধ্যমও বটে। তাই, বৈশাখী খাবার উৎসবের সাথে যেমন একান্তভাবে জড়িত, তেমনি এটি বাঙালি জীবনের একটি নান্দনিক এবং সাংস্কৃতিক উপকরণ, যা যুগ যুগ ধরে তাদের পরিচয়কে গর্বের সাথে ধরে রেখেছে। অনেকে বলেন বৈশাখ আসে যায়-বাঙালীর ঐতিহ্য রয়েই যায়।
রাজু