ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৯ চৈত্র ১৪৩১

প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য লালখাতায় হালখাতা

নিজস্ব সংবাদদাতা, আমতলী, বরগুনা

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ১২ এপ্রিল ২০২৫

প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য লালখাতায় হালখাতা

ছবিঃ সংগৃহীত

পুরোনো হিসাব-নিকাশ চুকে নতুন বছরে নতুন খাতায় নাম তোলাই হলো হালখাতা। ‘হালখাতা’ আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানের হিসাব আনুষ্ঠানিক হালনাগাদের এ প্রক্রিয়ায় ভাটা পড়েছে। পয়লা বৈশাখ থেকে হালখাতা শুরু হয়ে চলে পুরো মাসজুড়ে। গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য একটু ভাটা পড়লেও একেবারে গুটিয়ে যায়নি। ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতাদের পুরোনো হিসাবের খাতা বন্ধ ও নতুন বছরে নতুন খাতা খোলার আনন্দ-আয়োজন, আনন্দ-উল্লাস, মিষ্টিমুখ ও আনুষ্ঠানিকতায় জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু বিগত বছরের তুলনায় এ বছর হালখাতা অনেকাংশে কম।

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০-১১ মার্চ সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন হয় তৎকালীন ভারতবর্ষে। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, তা-ই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত।

হালখাতা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে এ দিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য ক্রেতাদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় ‘শুভ হালখাতা কার্ড’-এর মাধ্যমে। হালখাতার কার্ডের মাধ্যমে ওই বিশেষ দিনে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান। ক্রেতা তাদের সামর্থ্যানুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দেন।

আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের পুরো বছরের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকে "হালখাতা"-র উদ্ভব। পয়লা বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ পূজার মাধ্যমে দিনের শুভ সূচনা করেন। দেবতার পায়ে ছোঁয়ানো সিন্দুরে স্বস্তিকা চিহ্ন অঙ্কিত ও চন্দনচর্চিত খাতায় নতুন বছরের হিসাব-নিকাশ শুরু করা হয়।

আগে হালখাতায় অনেক আনন্দ হতো। দোকানে দোকানে প্লেটে করে মিষ্টি বিতরণ করা হতো। ক্রেতারা পুরোনো হিসাব পরিশোধ করতে আসতো। ক্রেতাদের জন্য দোকানে চা, মিষ্টি, সন্দেশসহ নানা আয়োজন থাকতো। মহাজনেরা দোকানে নতুন পণ্য দিতো, সেই পণ্য সিঁদুরের ফোঁটা দিত দোকানিরা। গদিতে উঠতো নতুন পাটি।

পয়লা বৈশাখে হালখাতা বাঙালি ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্যবাহী অংশ হলেও বর্তমানে হালখাতা আর আগের মতো জমজমাট নেই। তবুও শহর-গ্রামের অনেক ব্যবসায়ী হালখাতার রেওয়াজ ধরে রেখেছেন। তবে শহরের চেয়ে গ্রামে হালখাতার প্রচলন এখনো বেশী রয়েছে।

বর্তমান আধুনিক যুগে আদিকালের হালখাতা অনেকটা উঠে গেছে। ‘হালখাতা’ শব্দটি শুনলেই চোখে ভাসে মোটা রঙের লালখাতা। দোকানিরা লাল খাতায় লিখে রাখেন পুরো বছরের বাকির হিসাব। বৈশাখের প্রথম দিন দোকানিকে বাকি পরিশোধ করতে গেলে তাদের আপ্যায়ন করাটাই হালখাতার ঐতিহ্য।

বেশ কয়েক ধরনের লাল রঙের খাতায় হালখাতা চালু আছে বাজারে। এসব খাতার দামে ও নামে রয়েছে চমক। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে মানুষ আস্তে আস্তে হালখাতা ব্যবহার থেকে সরে আসছে। দিন যত যাচ্ছে হালখাতার ভবিষ্যৎ ততই অন্ধকার বলে মনে করেন অনেক ব্যবসায়ীরা।

হালখাতাকে ঘিরে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে বিশেষ হালখাতা কার্ড। যে কার্ড দিয়ে দোকানিরা ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানান হালখাতা উৎসবে। আমতলী বাজারে লালসালু হাফ টালি খাতা ৭০-৭০০ টাকা, টালি ৬০-৩৬০, বাউন্ড বুক খাতা ৭০-৩৫০ ও রেজিস্টার খাতা ১৫০-৮০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

শনিবার আমতলী পৌর শহরের বিভিন্ন পুস্তক বিক্রেতাদের দোকানে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পুস্তকের দোকানে সারি সারি লালসালুর খাতা সাজিয়ে রেখেছে পুস্তক ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারা ওই খাতা ক্রয় করে নিচ্ছেন। দোকানে বিভিন্ন বাহারি ধরনের হালখাতার কার্ড বিক্রি হচ্ছে।

আমতলী পৌর শহরের মুদি মনোহরদি ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, “ক্রেতাদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা আদায়ের জন্য রবিবার ও সোমবার দুই দিনের হালখাতার আয়োজন করেছি।”

আমতলীর খেকুয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস. এম. মহিউদ্দিন স্বপন বলেন, “পয়লা বৈশাখে পুরাতন বছরের হিসাব-নিকাশ শোধ করে দোকানীরা মিষ্টিমুখ করিয়ে ক্রেতাদের স্বাগত জানানোর আনন্দ অতুলনীয়। কিন্তু এখন তেমন আর আনন্দ হয় না।”

ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরীর কর্মচারী মোঃ রাকিবুল বাশার ও ভাই ভাই লাইব্রেরীর কর্মচারী মোঃ শাহীন বলেন, “আগের মতো এখন আর ধুমধামে হালখাতার প্রচলন নেই। টালি খাতা ও হালখাতার চিঠি বিক্রি কিছুটা কম।”

আমতলী উপজেলা পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ সাকিব আকন বলেন, “আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হালখাতায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। প্রতিবছর বৈশাখের পূর্বে কয়েক হাজার লালখাতা বিক্রি হতো, কিন্তু এখন অনেক কমে গেছে।”

আমতলী জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি পরিতোষ কর্মকার বলেন, “হালখাতা শত শত বছরের পুরানো ঐতিহ্য। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সেতুবন্ধন হলো হালখাতা। কিন্তু বেচাকেনা কম বিধায় ব্যবসায়ীদের অনেক সমস্যা, তাই হালখাতাও কম হচ্ছে।”
 

মারিয়া

×