
ছবি: সংগৃহীত
সাগরপারের জনপদ কলাপাড়ায় প্রকৃত জেলেদের স্বচ্ছতার সঙ্গে বিশেষ ভিজিএফ চাল বিতরণের লক্ষ্যে তালিকা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে পুরোনো তালিকায় জেলে কার্ডধারী অন্তত সাত হাজার নাম বাদ দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আপাতত পেশাপরিবর্তন, মৃত ও স্থানান্তরিত হওয়া সাত হাজার কার্ডধারী জেলের নাম বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভিজিএফ বঞ্চিত হাজারো জেলেদের ত্রটিপূর্ণ তালিকা হালনাগাদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা শনিবার জনকন্ঠকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি এও জানান, এছাড়া নতুন করে জেলে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ১২টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভা থেকে আরো প্রায় ১২ হাজার নামের তালিকা জমা পড়েছে।
কলাপাড়ায় পুরোনো তালিকা অনুসারে কার্ডধারী জেলে তালিকার সংখ্যা ১৮৩০৫ জন। এ তালিকা তৈরির পর থেকে বঞ্চিত প্রকৃত জেলেরা বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ তুলে আসছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান মেম্বারসহ তাদের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা জেলে তালিকায় তাদের পছন্দের লোকজনের নামে জেলে কার্ড করে চাল বিতরণ করেছে। প্রকৃত জলেদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অপেশাদার লোকজনকে সরকারের বিশেষ প্রণোদনার চাল দেওয়া হয়েছে। এনিয়ে চাল বিতরণকালে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ এবছরের মার্চ-এপ্রিল দুই মাসের জাটকা আহরণ থেকে বিরত থাকা জেলেদের চাল বিতরণ নিয়ে তিন দিন দিন আগে ধুলাসার ইউনিয়নে একই দলের নেতাকর্মীদের বিরোধে মারধরে গুরুতর জখম হয় যুবদল নেতা রাকিব বিশ্বাস। বর্তমানে ওই ইউনিয়নের জেলে চাল বিতরণ বন্ধ রয়েছে। চাল বিতরণ নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতার। ধুলাসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাফেজ মো. আবদুর রহিম জানান, একজনের চাল ভাগ করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ৪০ কেজি করে দেওয়ার চেষ্টা চালায় তারা। এছাড়া জেলে কার্ড নাই এমন ব্যক্তিকেও চাল দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। তাই তদারকি অফিসার ও ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপাতত চাল বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর আগে কুয়াকাটা পৌর সভায় বঞ্চিত জেলেরা বিক্ষোভ করেছে।
কলাপাড়ায় কার্ডধারী তালিকাভুক্ত জেলে রয়েছে ১৮৩০৫ জন। কিন্তু ১২ টি ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভার জন্য চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২৬৩৬ জনের। কারণ শুধু জাটকা আহরণ থেকে বিরত থাকাকালীন সাগর-নদীতে মাছ শিকার করা প্রকৃত জেলে পরিবারের খাদ্য সহায়তায় সরকারিভাবে মার্চ-এপ্রিল দুই মাসের জন্য এ চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রত্যেক পরিবার এক সঙ্গে ৮০ কেজি করে চাল পাওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে এ চাল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ঈদের আগেই খাদ্যগুদাম থেকে চাল উত্তোলন শুরু হয়। কিন্তু প্রকৃত জেলে পরিবারে চাল বিতরণ নিয়ে চলছে অরাজক কারবার। তালিকার চেয়ে বরাদ্দ কম থাকার অজুহাত দেখিয়ে কার্ডধারী জেলেকে বাদ দিয়ে ¯িøপ হাতে ধরিয়ে কোথাও চাল বিতরণ করা হয়। আবার কোথাও আওয়ামী সমর্থক মেম্বার হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতে এ চাল বিতরণে বিএনপির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাদের পছন্দের লোকজন কে চাল বিতরণে বাধ্য করছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে নিয়োজিত তদারকি কর্মকর্তারা এ নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। তবে ত্রুটিযুক্ত তালিকার অজুহাত ধরেই চাল বিতরণে প্রত্যেকবারে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এসব অনিয়মের সঙ্গে আবার কতিপয় তদারকি কর্মকর্তার আপোষকামীতার অভিযোগ রয়েছে।
উদাহরণ দিয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, চাকামইয়া ইউনিয়নে আগের মোট কার্ডধারী জেলের সংখ্যা ছিল সাড়ে আট শ’ জন। যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত জেলে পাওয়া গেছে প্রায় তিন শ’ জন। আবার নতুন করে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে দেড় সহ¯সহস্রাধিক নাম পাওয়া গেছে। একইভাবে মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নে পুরোনো কার্ডধারী এক হাজার জেলের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে প্রায় ৫০০ জন প্রকৃত জেলে পাওয়া গেছে। আবার এখানে নতুন করে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে ৭০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। এভাবে পুরোনো কার্ডধারী তালিকা যাচাই-বাছাই করে গোটা উপজেলায় অন্তত সাত হাজার অপেশাদার, প্রকৃত জেলে নয় এমন নাম চিহ্নিত করা হয়েছে। এ নিয়ে বর্তমানে মৎস্য কর্মকর্তাসহ ইউপি চেয়ারম্যানরাও বিপাকে পড়েছেন। তাদের দাবি, প্রকৃত জেলের তালিকা তৈরি করা নিয়ে ৫ আগস্টের আগে এক ধরনের সমস্যা ছিল। এখন আবার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি নিয়ে নতুন সমস্যায় পড়েছেন।
মৎস্য কর্মকর্তা জানান, অধিকাংশ ইউনিয়নে চাল বিতরণ করা হয়েছে। বরাদ্দ তালিকার চেয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার জনের চালের বরাদ্দ কম পাওয়ায় জটিলতা হয়েছে। তবে ধানখালী, নীলগঞ্জ, লতাচাপলী ও ধুলাসারে ছাড়া বাকি সব ইউনিয়নে চাল বিতরণ করা হয়েছে। দুই চারদিনের মধ্যে ওই চারটিতেও বিতরণ করা হবে। আর প্রত্যেক ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি ও তদারকি অফিসারদের সঙ্গে সমন্বয় করে জেলেদের নতুন তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির পটুয়াখালী জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক লালুয়ার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম জানান, সাগর নদীতে ইলিশ ধরা প্রকৃত জেলের তালিকা তৈরি করতে শুধু আন্তরিকতা থাকা দরকার। তার দাবি তালিকা দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
মহিপুর বন্দর মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সহ সভাপতি রাজু আহমেদ রাজা জানান, প্রকৃত জেলে তালিকা করতে মৎস্য ব্যবসায়ী, ট্রলার মালিক, আড়ত মালিক, জেলে সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এছাড়া খসড়া তালিকা প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের সামনে প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করলে প্রকৃত জেলের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে।
তবে অধিকাংশ জেলে এবং মৎস্য ব্যবসায়ীর মতামত কলাপাড়ায় সবচেয়ে বেশি জেলে অধ্যুষিত মহিপুর, লতাচাপলী, ধূলাসার, লালুয়া, ধানখালী, চম্পাপুর, বালিয়াতলী ইউনিয়ন ও কুয়াকাটা পৌর এলাকা। বাকি ইউনিয়নে নদী কিংবা সাগরে মাছ ধরার প্রকৃত জেলের সংখ্যা অনেক কম। এ বিষয় টি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। জেলেদের দাবি তালিকা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শেষ না হওয়ার সুযোগে চাল বিতরণ নিয়ে চলছে অরাজক পরিস্থিতি।
মেজবাহউদ্দিন মাননু / ফারুক