ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

উত্তরাঞ্চলের প্রিয় মুখরোচক খাবার সিঁদল

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী।

প্রকাশিত: ০২:৪৪, ১২ এপ্রিল ২০২৫

উত্তরাঞ্চলের প্রিয় মুখরোচক খাবার সিঁদল

বাহের দেশ রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় গ্রামের কৃষক বশির উদ্দিন (৫৫) বলছিলেন আইজ কয়দিন থাকি কেন বা মুখত খাবারের রুচিটা  নস্ট হয়া গেছিল। মুখত কোন স্বাদগন্ধ পাছিনু না। বাড়ির ওমাক (স্ত্রী) পিয়াজ মরিচ বেশী করি দিয়া সিঁদলের ভর্তা করি দেতো, গরম ভাত দিয়া এনা খাইম। কি আর কমু বাহে-তিন থালা ভাত সিঁদলের ভর্তা দিয়া ঠাসি দিনু। ম্যালা দিন পর মনে হইল অমৃত খানু।


আসলেই মুখরোচক খাবার সিঁদল। যে কোন মানুষকে এর ভর্তা স্বাদ পাগল করে দিবে। শুধু ভর্তা না। মাগুড় মাছ বা শাঠি মাছ দিয়ে সিঁদুল মিলিয়ে রান্না করলে ভাতের থানা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। এ অঞ্চলে বলা হয়ে থাকে  ছোট মাছের শুঁটকি ও কচুর ডাটা দিয়ে তৈরি করা এক প্রকারের খাবারের নাম সিদল। রংপুর অঞ্চলের, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার গ্রামবাংলার মুখরোচক খাবার হিসেবে এর কদর রয়েছে যথেষ্ট। সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বাদের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের এটি অতিপ্রিয় একটি খাবার।


পারিবারিক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, আত্বীয়-স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো সওদা হিসেবে কিংবা নিজ বাড়িতে  আপ্যায়নের ক্ষেত্রে একসময় সিঁদল ছিল অন্যতম একটি উপকরণ। শুধু তা-ই নয়, হাটে-বাজারে বিক্রিও হতো গ্রামীণ পরিবারের নারীদের হাতের তৈরি এই মুখরোচক খাবার। হঠাৎ করে দেশীয় ছোট মাছের সংকটে  এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবারটি এখন আর ব্যাপক ভাবে পাওয়া যায়না। তবে যা সামান্য তৈরী করে গ্রামের বধুরা তা আর বাজারে কিনতে পাওয়া যায়না। তবে নিজের জন্য তৈরী করা হয়।  

যা শখের বশে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী খাবারটি এখনো তৈরি করেন। বিশেষ করে বর্ষাকালে সিঁদল তৈরী করা হয়। যা পরের বর্ষা আসা আসা পর্যন্ত সংরক্ষন করে খাওয়া হয়। মূলত তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ, যেমন-মলা, ডারকা বা পুঁটিসহ বিভিন্ন ছোট জাতের মাছ দিয়ে। প্রথমে মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে কড়া রোদে ৫-৬ দিন শুকিয়ে নিতে হয়। মচমচে হলে মাছের শুঁটকিগুলো উরুন গাইন (কাঠের বড় হামানদিস্তা) বা শিল-পাটায় গুঁড়া করে নিতে হয়। এরপর সাদা মানকচু ও কালো কচুর শুধু ডাঁটা ধুয়ে নিয়ে কাঁচা অবস্থায়ই বাটতে হয়।

কচুবাটার সঙ্গে মলা, ডারকা বা পুঁটি মাছের আধাভাঙা গুঁড়া, প্রয়োজনমতো শুকনা মরিচ, লবণ, রসুন, আদা বাটা সবকিছুর সঙ্গে মেশাতে হয়। সব মেশানো হয়ে গেলে একদিন পর হলুদ ও সরিষার তেল দিয়ে মেখে হাত দিয়ে গোল বা চ্যাপটা করে ৫-৬ দিন রোদে শুকাতে হয়। ডালা বা কুলায় ঢেকে (যাতে পাখি খেতে না পারে) শুকিয়ে একটু শক্ত হলে তৈরি হয় সিদল। পরে শুকনো পাতিলে সংরণ করতে হয়। পাতিলে কিছু ছাই দিয়ে রাখলে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট পোকার আক্রমণের হাত থেকে রা পাওয়া যাবে। শুকনো সিদল প্লাস্টিকের কাগজে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের বক্সে রেফ্রিজারেটরে রাখলে এক বছর ভালো থাকে। এ ক্ষেত্রে মাঝেমাঝে রোদে শুকানোর প্রয়োজন রয়েছে।


নীলফামারীর একজন শ্রেষ্ঠ রাধুনী ফৌজিয়া ইয়াসমিন জলি জানান, রান্না করার সময় সিদল থেকে ছাই ফু দিয়ে তুলে পরিষ্কার করার পর ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়। বিভিন্নভাবে সিদল রান্না করা যায়। মাগুর মাছ শাঠি মাছ বা কাতলা বা বোয়াল মাছের সাথে সিদল মিশিয়ে একটু বেশি ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়। শাক দিয়ে সিদল রান্নার প্রচলন সুপরিচিত হলেও জনপ্রিয় রান্নার পদ্ধতি হচ্ছে সিদল ভর্তা। পাত্রে ভাত নামানোর ৫ মিনিট আগে সিদল ভাতে দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হয়। পরবর্তীতে সেটি হালকা তেলে ভেজে ভাজা মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, লবণ, সরিষার তেল দিয়ে ভালো করে হাত দিয়ে বা পাটায় পিষে ভর্তা করতে হয়।


তিনি জানান, একসময় এ অঞ্চলের খাল-বিল, নদী-নালাসহ ছোট-বড় সব ধরনের পুকুরে দেশি ছোট মাছে ভরপুর ছিল। তখন সিদল তৈরি করাটা অনেকের কাছে শখের পাশাপাশি পেশাও ছিল। কালের বিবর্তনে মাছের সংকট এবং নানা ব্যস্ততার কারণে এখন কেই বেশী করে সিঁদল তৈরী করেনা। যা করে তা নিজ ঘরের জন্যই করেন।  বিশেষ করে শহর থেকে ছেলে-মেয়ে বা জামাই বেড়াতে এলে বছরে এক-দুইবার তাদের জন্য সিদল খাওয়াতে হয়। এ ছাড়া কৃষকরাতো মুখের স্বাদ ধরে রাখতে সিঁদল তরকারি খাবেই।


নীলফামারীর লেখক ও সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা জানান, সিদল একটি সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার। এটি আমার বাড়িতে রাখা হয়। অন্তত মাসে ২-৩ বার সিদল দিয়ে তৈরি করা খাবার খাই। এখন সিদল তৈরির মাছ বাজারে পাওয়া গেলে তা নিষেই শেষ হয়ে যায়। সবার নজর ছোট মাছে। কারন ওই মাছ পেলেই সিদল তৈরী হবেই হবে। 

রিফাত

×