ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

অভাব হিমাগারের

আলু সংরক্ষণে বিপাকে কৃষক রেকর্ড আবাদ ৩০ লাখ টন

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ১১ এপ্রিল ২০২৫

আলু সংরক্ষণে বিপাকে কৃষক রেকর্ড আবাদ ৩০ লাখ টন

.

চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে আলুর আবাদ রেকর্ড পরিমাণ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলা নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার হিমাগার সংকটে কৃষকরা উৎপাদিত আলু সংরক্ষণে বিপাকে পড়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় ৭১ টি হিমাগারে ধারণ ক্ষমতা ৭ লাখ ৩২ হাজার ৫৭২ মেট্রিক টন। সেখানে এবার (চলমান) আলু উৎপাদন হয়েছে  ২৯ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৫ মেট্রিক টন। ফলে, হিমাগারে জায়গা না থাকায় আলু চাষিরা সব থেকে বিপাকে পড়েছেন। তবে আলু চাষিদের অভিযোগ, বীজ আলু দেরি করে ওঠে। এই আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে না পারলে আগামী মৌসুমে বীজ আলুর চরম সংকট সৃষ্টি হবে।
সরেজমিনে ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, রংপুর অঞ্চলের নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলায় এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক লাখ ৬০২ হেক্টর জমিতে।  সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৭৩৯ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে রংপুরে ৬৬ হাজার ২৮০ হেক্টর, নীলফামারীতে ২৩ হাজার ১৫৬ হেক্টর, গাইবান্ধায় ১৪ হাজার ৪৯৭ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ৮ হাজার হেক্টর ও লালমনিরহাটে ৭ হাজার হেক্টর। সূত্র মতে, গড় হিসাবে প্রতিহেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছে ২৫ মেট্রিক করে।  সূত্র মতে, রংপুর অঞ্চলের মধ্যে রংপুর জেলায় ৪১ টি, নীলফামারীতে ১১ টি, লালমনিরহাটে ৯ টি, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে ৫ টি করে মোট হিমাগার রয়েছে ৭১ টি। যার ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৭ লাখ ৩২ হাজার ৫৭২ মেট্রিক টন। সেখানে আলু উৎপাদন হয়েছে ২৯ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৫ মেট্রিক টন।
 নীলফামারীর সদরের রামনগর এলাকার আলু চাষি পারভেজ মিয়া (৩৬)। তিনি গত ৫ দিন ধরে ১০০ বস্তা আলু নিয়ে হিমাগারের সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করতে করতে নামমাত্র মূল্যে আলু বিক্রি করে বাড়ি ফিরে গেছেন। এতে তার আলু উৎপাদনের খরচ ওঠানো দূরের কথা, পরিবহনের খরচেই তিনি শেষ। পারভেজ বলেন, বিএডিসির আলুবীজ কিনে বেশ ভালো ফলন হলেও হিমাগারে জায়গা না পাওয়ায় সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। ৫ দিন ধরে আলুর জন্য গাড়ি ভাড়া করে এনে বসিয়ে রাখছি, এখন কম দামে বেচে দিতে বাধ্য হয়েছি।  শুধু আলু চাষি পারভেজই নয়, শতশত আলু চাষির কপালে ভাঁজ পড়েছে। এদিকে জমি থেকে দেরিতে ওঠা বীজআলু হিমাগারে রাখতে না পারলে পরের বছর বীজআলু নিয়ে হাহাকার পড়ে যাবে, সংকটে পড়বে দেশ। এ কারণে অন্তত বীজআলুগুলো হিমাগারে রাখার জোর দাবি তুলেছেন আলু চাষিরা।
কৃষকরা জানিয়েছেন, একদিকে দাম নেই, অন্যদিকে হিমাগার মালিকরা মাইকে ঘোষণা করছেন তাদের হিমাগারে আলু রাখতে পারবে না। এই অবস্থায় পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় বসা ছাড়া উপায় নেই। কেউ কেউ আলু বস্তায় ভরে জমিতেই ফেলে রাখছেন, আবার অনেকে মহাসড়কের পাশে রাখছেন। কৃষকরা বলছেন, অনুরোধ করার পরও আলু নিচ্ছে না হিমাগার কর্তৃপক্ষ। এমনকি দালাল ফড়িয়াদের বাকিতে আলু দিতে চাইলেও তারা নিচ্ছেন না। উৎপাদন প্রতিকেজি ২০ টাকা হলেও ৮-৯ টাকা কেজি দরে গ্রানুলা আলু পাইকারদের দিতে চাইলেও জায়গা না থাকার অজুহাতে তারাও নিচ্ছেন না। কৃষকরা জানান, মূলত বীজআলু দেরিতে ওঠে। এই বীজআলু স্টোরে রাখতে না পারলে আগামী মৌসুমে আলুবীজের চরম সংকট দেখা দেবে। মকবুল হোসেন বলেন, ১০০ বস্তা আলু নিয়ে শনিবার এসেছি হিমাগারের সামনে। এসে শুনি জায়গা নেই। কর্তৃপক্ষ আলু নেবে না বলে মাইকে ঘোষণা করছে। আমার সেই আলু এখন রাস্তায়। প্রতিটি হিমাগারের পক্ষে বলা হয়েছে,  আলু রাখার জায়গা নেই।
আলু চাষিরা জানান, গত মৌসুমে প্রতিকেজি আলুর দাম উঠেছিল ৭০-৮০ টাকা পর্যন্ত। তাতে কমবেশি সবাই লাভবান হয়েছেন। সেই আশায় এবার বেশি জমিতে আবাদ করেছেন। এবার মৌসুমের শুরুতেই প্রতিকেজি বিক্রি হয় ৯০ টাকায়। এখন মাঠে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকায়। এদিকে খুচরা বাজারে আলুর দাম ১৮-২৫ হলেও চাষিদের কাছ থেকে তা ১২-১৩ টাকা কেজিতে কিনে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্থভোগীরা। চাষিরা আরও জানান, এক দোন (২৪ শতক) জমিতে আলু চাষ করতে ২৩০ কেজি বীজ ব্যবহার হয়েছে, যার বাজারমূল্য ২৫ হাজার ৩০০ টাকা। এ ছাড়া সার, কীটনাশক, স্প্রে, শ্রমিক, সেচ ও জমি ভাড়া মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী ফলন বিক্রি করে এ খরচ উঠবে না বলে তারা জানান।
এবার উক্ত ৫ জেলায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি জমিতে আলু উৎপাদন হওয়ায়, সেই আলু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন প্রান্তিক আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা। জায়গা সংকুলান না হওয়ার কারণ দেখিয়ে বেশির ভাগ হিমাগার কর্তৃপক্ষ আলু নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে, জমিতে-রাস্তায় হাজার হাজার বস্তা আলু রেখে কৃষকরা দুশ্চিন্তায়। এদিকে জমি থেকে দেরিতে ওঠা বীজআলু হিমাগারে রাখতে না পারলে পরের বছর বীজআলু নিয়ে হাহাকার পড়ে যাবে, সংকটে পড়বে দেশ। এ কারণে অন্তত বীজআলুগুলো হিমাগারে রাখার জোর দাবি তুলেছেন আলু চাষিরা। কৃষকরা জানিয়েছেন, একদিকে দাম নেই, অন্যদিকে হিমাগার মালিকরা মাইকে ঘোষণা করছেন তাদের হিমাগারে আলু রাখতে পারবে না। এই অবস্থায় পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় বসা ছাড়া উপায় নেই।
কৃষকদের অভিযোগ, অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অনেকেই আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না। ফলে, বাধ্য হয়ে তারা কম দামে আলু বিক্রি করছেন, যা চাষাবাদের খরচও তুলতে পারছে না। কৃষক আব্দুল মতিন আলু নিয়ে হিমাগারে এলেও জায়গা পাননি। তিনি বলেন, আমার ৫০ বস্তা আলু সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনদিন ধরে ঘুরেও হিমাগারে জায়গা পাইনি। গাড়ি ভাড়া দিয়েও অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে, এখন মনে হচ্ছে কম দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই। অপর আলু চাষি জসিম উদ্দিন (৪৫) বলেন, গত বছর হিমাগারে জায়গা পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার অতিরিক্ত চাষ ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে আলু রাখতে পারছি না। হিমাগারে রাখতে পারলে অন্তত দামটা ভালো পাওয়া যেত। এখন ৪০০ টাকা মণ দামে বিক্রি করতে হচ্ছে, যা চাষের খরচও উঠছে না।

×