ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

শত বছরের পরিচিতি, দক্ষিণের কলাপাড়ার ঐতিহ্য জগবন্ধুর মিষ্টি

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ১১ এপ্রিল ২০২৫

শত বছরের পরিচিতি, দক্ষিণের কলাপাড়ার ঐতিহ্য জগবন্ধুর মিষ্টি

ছবি: সংগৃহীত

জগার মিষ্টি। এক নামেই পরিচয়। আমলা, রাজনীতিক, মন্ত্রী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাইকে তুষ্ট করতে এর যেন কোন বিকল্প কিছুই নেই। প্রতিষ্ঠানের পুরো নাম জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডার। মিষ্টির জন্য এখানে প্রতিদিন বহু দামী ব্রান্ডের গাড়ি ব্রেক কষে। সরকারি বেসরকারি দপ্তরে আটকে থাকা ফাইলের গতিও সচল করতে জগবন্ধুর মিষ্টির সুনাম রয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা সদরের নতুন বাজার পূর্ব গলিতে অবস্থান এই প্রতিষ্ঠানের।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত কলাপাড়াবাসীকে যেমন বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে, তেমনি জগার মিষ্টিও সুনাম কেড়েছে সর্বত্র। গরুর খাঁটি দুধের ছানা ও চিনির তৈরি জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টির স্বাদই আলাদা, যা না খেলে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। জগার মিষ্টির পরিচয় নিজেই।

এ মিষ্টি তৈরির রয়েছে শত বছরের দীর্ঘ ইতিহাস। জড়িয়ে রয়েছে জগন্নাথ হাওলাদারের পরিচিতি। প্রচলিত আছে এখানে জগার মিষ্টি এক টাকায় চারটি পাওয়া যেত, তাও অনেকে পয়সা দিত না। উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন জগন্নাথ হাওলাদার। বহু মানুষ বিনা পয়সায় তার মিষ্টি খেয়েছেন। তিনি সবার কাছে জগা দাদু কিংবা কাকু নামে পরিচিত ছিলেন। কখনো রাগ করে কাউকে কিছু বলতেন না।

কখন, কীভাবে, কবে মিষ্টির দোকানটির শুরু হয়েছে তার সঠিক দিনক্ষণ কেউ বলতে পারেনি। তবে এখানকার প্রবীণ মানুষেরা বলেছেন, ‘৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে কলাপাড়ায় ব্রিটিশ প্রতিনিধি কলোনাইজেশন অফিসার ছিলেন। সর্বশেষ যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল ডিকে পাওয়ার ডোনাবান। সমাজসেবক ও বাঙালিদের তিনি প্রিয় মানুষ ছিলেন। সে সময়ে (সম্ভবত ১৯২০-১৯২৩ সালে) পূর্ববাজারে (বর্তমানে নতুন বাজার পূবের গলি) জগবন্ধু হাওলাদার অন্যের ছোট্ট একটি চায়ের দোকান পরিচালনা করতেন। প্রতি সন্ধায় ওই চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন গণ্যমান্য লোকজন। তখনকার এই শহরে থাকা একজন শিক্ষক পিনাকী চক্রবর্তী ও ডোনাবান সাহেবও বসতেন। তাঁদের উৎসাহেই গড়ে তোলেন মিষ্টির দোকান। পিনাকী বাবু ছিলেন কলকাতার মানুষ। জীবনসায়াহ্নে এসে জগবন্ধু হাওলাদারও এ কথায় সায় দিয়েছিলেন।

দুধ দিয়ে ছানা তৈরি করে চিনি ও পানির মিশ্রণে রস (সিরা) দিয়ে বানানো হয় (রসগোল্লা) মিষ্টি। জগবন্ধু হাওলাদারও তাঁদের কাছ থেকে মিষ্টি বানানোর কৌশল জেনে নেন। তৈরি করেন, করেন শুরু বিক্রি। ক্রমশ প্রসার লাভ করে তার দোকানের। বাড়তে থাকে মিষ্টির চাহিদা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ থাকে এই মিষ্টি। অতিথি আপ্যাায়নে জগবন্ধুর মিষ্টি হয়ে ওঠে অপরিহার্য। এরপর কলাপাড়ার বাইরেও ছড়াতে থাকে এর সুনাম। নিজেরা তৃপ্তি ভরে খায়। নিয়ে যায় মানুষ তাঁদের স্বজন-পরিজনদের জন্য।

এখন দিনভর চলে মিষ্টির বেচাকেনা। প্যাকেটে প্যাকেটে মিষ্টি যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিশিষ্ট রাজনীতিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা একবার যারা এই মিষ্টির স্বাদ পেয়েছেন তাঁদের মেন্যুতে থাকছেই জগার মিষ্টির তালিকা। তবে সন্ধ্যেবেলায় পাওয়া যায় গরম গরম মিষ্টি।

কুয়াকাটায় যারাই আসেন তাঁদের একটি বড় অংশ জগার মিষ্টি নিতে ভোলেন না। অধিকাংশ কর্মকর্তারাই অফিস ভিজিট, ট্যুরসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামে এলে তাঁদের মনে না থাকলেও এখানকার (অধঃস্তন) কর্মকর্তারা স্যারকে খুশি করতে জগার মিষ্টি খাওয়াতে কিংবা সাথে দিয়ে দিতে ভোলেন না।

জগবন্ধু হাওলাদার নেই। পরলোকে গেছেন ১৯৯১ সালে। শক্ত হাতে দোকানের হাল ধরেছেন বড় ছেলে নিখিল চন্দ্র হাওলাদারসহ অন্যরা। রেখে গেছেন যোগ্য অনেক কারিগর। তখন প্রধান কারিগর ছিলেন নেপাল চন্দ্র। তিনিও ইহলোক ছেড়েছেন। এখন রয়েছে অসংখ্য উদ্যমী কারিগর।

জনাব নিখিল চন্দ্রের মতে, তাদের এই দোকানের বয়স অন্তত শত বছর। দেখালেন তার বাবার ব্যবহারের কাঠের তৈরি শত বছরের পুরনো ক্যাশবাক্সটি স্বযত্নে কাউন্টারের ডান পাশেই রেখেছেন। দৈনিক কী পরিমাণ কিংবা কত সংক্ষক মিষ্টি বিক্রি হয় এটির সঠিকভাবে জানাতে না পারলেও ভালোই বেচাকেনা হয় বলে জানান নিখিল চন্দ্র হাওলাদার। তবে খাঁটি দুধের সংকটের কথা জানালেন তিনি। বেশি দামে সংগ্রহ করতে হয়। সব জিনিসের দামও এখন অনেক বেশি বলে দাবি তার। খরচ বহুগুনে বেড়ে গেছে। তারপরও বাবার ঐতিহ্য ও মানসম্পন্ন মিষ্টি এখনো তারা তৈরি করছেন বলে নিশ্চিত করেন।

কলাপাড়ার একজন গুণী মানুষ, খেপুপাড়া সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক মো. আব্দুল খালেক জানান, শত বছরের এই মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্তাধিকারী প্রয়াত জগবন্ধু হাওলাদার এখানকার কয়েক প্রজন্মের দাদা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় গুন ছিল- ওনার জীবদ্দশায় প্রতিদিনের তৈরি করা কোয়ালিটি সম্পন্ন মিষ্টি ক্রেতাদের কাছে তুলে দিতেন। যদি কখনো এক দিনের বানানো মিষ্টি পরের দিন অবিক্রিত থাকতো তা আর বিক্রি করতেন না। তিনি কাস্টমারের জন্য এতোটাই স্যাক্রিফাইস করতেন। আর ওনার মিষ্টি বিনা পয়সায় না খেয়েছে তখনকার সময় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত না। তবে তার উত্তসূরিরা এখনো সেই সুনাম ধরে রখেছেন। এটি কলাপাড়ার মানুষের জন্য একটি ভালো দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

জানা গেছে, পাকিস্তান আমলে ১ টাকায় ৮ টি রসগোল্লা বিক্রি হতো। স্বাধীনের পরে টাকায় ৪টি। পরে ২ টাকা করে বিক্রি হয়। পরে ৫ টাকা। বর্তমানে সাইজ ভেদে ২০-৩০ টাকা। তবে রসমালাই সহ অন্য মিষ্টির দাম আরো বেশি। সন্ধ্যে বেলা এখানে পাওয়া যায় গরম গরম মিষ্টি। অনেক সময় মিষ্টির সঙ্কট পড়ে যায়। বহুজনে আগাম অর্ডার দেন। এখানকার রসমালাই-সন্দেশও খুব স্বাদের। থাকে আরো হরেক রকম মিষ্টি। পথ চেনেন না এমন অনেক লোকজন এসে খোঁজেন- জগার মিষ্টির দোকান কোনটি।

আজ এই মিষ্টির দোকানের মূল উদ্যোক্তা নেই। তবুও ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন উত্তরসূরিরা। জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডার তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সুনামের সাথে। আপনিও খেতে কিংবা পরিজনের জন্য নিতে ভুলবেন না যেন। জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডার এখন কলাপাড়ার ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে আছে। আর এর সুখ্যাতিও বাড়ছে দিনকে দিন।

মায়মুনা

×