ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান

উত্তরোত্তর সমৃদ্ধিতে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্

সংবাদদাতা, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ০১:১২, ১১ এপ্রিল ২০২৫

উত্তরোত্তর সমৃদ্ধিতে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্

বাড়বকু- শিল্পাঞ্চলে স্থাপিত ইউএনআই এলপি গ্যাস কারখানা

দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে চট্টগ্রাামের সীতাকুণ্ডের। তবে একইসঙ্গে এলাকাটি এখন দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পাঞ্চল। বিশেষ করে গত দুই দশকে এখানে স্থাপিত হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপগুলোর একাধিক প্রতিষ্ঠান, যা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার সীতাকু- উপজেলা। শহর থেকে এই মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যেতে ডানপাশে একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন, ইস্পাত, কনটেনার ডিপো, গাড়ি সংযোজন, কাঁচসহ ভারি শিল্পের বহু কারখানা।

দেশের গাড়ি সংযোজনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ। মহাসড়কের বাঁপাশে সাগর উপকূলে তাকালে চোখে পড়ে পুরানো জাহাজের ফানেল বা চিমনি। এখানেই গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্প। এলপি গ্যাসের একাধিক কারখানাও রয়েছে মহাসড়কের দুই পাশে। 
সীতাকু-ের একাধিক শিল্পকারখানার উদ্যোক্তারা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তিতা, শ্রমিকের সহজলভ্যতা,  উৎপাদিত পণ্যের দ্রুত পরিবহন, জমির পর্যাপ্ততা, পাহাড়, মনোরম প্রকৃতিসহ শিল্পস্থাপনের উপযুক্ত পরিবেশের কারণে এ উপজেলা বহু আগেই শিল্প উদ্যোক্তাদের নজরে পড়ে। ফলে, এখানে প্রতিবছরই নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। ২৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সীতাকু-ে দুই শতাধিক শিল্পকারখানা রয়েছে। তার মধ্যে ভারি শিল্পের অন্তত ১৫০ টি কারখানা রয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, ১৯৬০-এর দশকে এখানে গড়ে উঠেছিল দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্প। উপজেলার ফৌজদারহাটে ঝড়ে ভেসে আসা ‘কুইন আল-পাইন’ নামের একটি জাহাজভাঙার মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর সময়ের সঙ্গে এ শিল্পের বিস্তার ঘটেছে। বর্তমানে এখানে ৫০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে। এ শিল্প থেকে প্রতিবছর প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে সরকার। এ ছাড়া দেশের নির্মাণশিল্পের অন্যতম সরঞ্জাম রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ লোহাসহ গুরুত্বপূর্ণ বহু সরঞ্জাম পাওয়া যায় এ শিল্প থেকে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখানে কাজ করছে অর্ধলক্ষ শ্রমিক।
সীতাকু-ের স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে সীতাকু-ে নতুন করে যোগ হয়েছে আরও বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে অন্যতম বসুন্ধরা গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, বিএসআরএম গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, কেডিএস গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, জিপিএইচ গ্রুপ, বিএম গ্রুপ, কেএসআরএমসহ দেড় শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাহাজভাঙা শিল্প ৭৫টি, রড-ঢেউটিনের ৪৩ টি, এলপিজি ৯ টি, বস্ত্রকল ৫ টি, পেট্রোলিয়াম পরিশোধন ৪ টি, সিমেন্ট ৩ টি, গাড়ি সংযোজন ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন কারখানা ৩ টি, গ্লাস ও টাইলসের একটি করে মোট ২ টি কারখানা রয়েছে। এর বাইরে অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাস উৎপাদনের ১০ টি, পোলট্রি খাতের ১১ টি ও ভোগ্যপণ্যের ৬ টি কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানি খাতে বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার লেনদেন করে, এমন শিল্প গ্রুপের সংখ্যা আট।

শুধু সীতাকু-ে কারখানা রয়েছে বিলিয়ন ডলার ক্লাবের তিনটি শিল্পগ্রুপের। গ্রুপ তিনটি হলো- আবুল খায়ের, বিএসআরএম এবং টিকে গ্রুপ। এ ছাড়া বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্প গ্রুপের ৫০ টির মতো প্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন রয়েছে বারৈয়াঢালা, বাড়বকু-, বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্থানে। এ ছাড়া মুরাদপুর সাগর উপকূলে নতুন সমুদ্রবন্দর স্থাপনের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সীতাকু- উপজেলা এখন দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পাঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
ইস্পাত খাতের চারটি বৃহৎ কোম্পানির কারখানা রয়েছে সীতাকু-ে। কোম্পানি চারটি হলো- বিএসআরএম গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, জিপিএইচ গ্রুপ ও কেএসআরএম গ্রুপ। এর বাইরে রয়েছে রড উৎপাদনের ৩৩টি সনাতন ও আধা স্বয়ংক্রিয় কারখানা। সব মিলিয়ে সীতাকু-ের কারখানাগুলোর মোট রড উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ৬০ লাখ টন। তবে কাঁচামাল আমদানি ও কোম্পানিগুলোর প্রাথমিক হিসাবে গত বছর অন্তত ৩৩ লাখ টন রড উৎপাদন হয়েছে এসব কারখানায়, যা দেশের মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি।
সূত্র মতে, সীতাকু-ে শিল্পের অতি দ্রুত বিকাশের কারণে  কয়েক বছর আগেই এ উপজেলাকে অকৃষি ভূমি উপজেলা ঘোষণা করা হয়েছে। যেভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটছে, তাতে আগামী দুই দশকে সমগ্র উপজেলাটি শিল্পাঞ্চলে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সরেজমিনে শিল্পের এই ক্রমবিকাশ পর্যবেক্ষণে সম্প্রতি উপজেলার নির্বিতব্য শিল্পাঞ্চল বাড়বকু- সাগর উপকূল ঘুরে দেখা গেছে, এখানে অন্তত ২০ টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মিত হচ্ছে। তার মধ্যে জেএমআই, ইউএনআই, বিএন গ্যাস কারখানাসহ পাঁচটি কারখানা পুরোদমে উৎপাদন শুরু করেছে।

আরও কয়েকটি নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। বাড়বকু-ে বেশিরভাগই গ্যাস বিপণন প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। বিদেশ থেকে গ্যাস এনে প্রতিষ্ঠানগুলোর রিজার্ভারে সঞ্চিত রেখে তা থেকে গ্যাস বোতলজাত করে সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। পিএইচপি ফ্লোট গ্লাাস ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আমির হোসেন বলেন, বন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় সীতাকু- অঞ্চলে শিল্পকারখানা স্থাপনের উদ্যোক্তাদের পছন্দের এলাকা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও প্রশস্ত হয়েছে।

এছাড়া সীতাকু-ে চার-পাঁচটি জেটি করা গেলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে কম সময় ও কম খরচে কাঁচামাল কারখানায় আনা যাবে। এতে বন্দরের ওপর চাপ কমবে। একই সঙ্গে ঢাকা, বরিশালসহ বিভিন্ন নৌপথে কম খরচে পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে। কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, সীতাকু- শিল্পাঞ্চলে চাঁদাবাজি নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখন অনেক গ্রুপকে চাঁদা দিতে হয়।

চাঁদা না দিলে ক্ষতি হতে পারে, এমন আশঙ্কায় চাঁদাবাজদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। বিশেষ করে সরকারের পটপরিবর্তনের পর অনেক গ্রুপ নানা অজুহাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায় করছে। সোনাইছড়ি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও শিল্পোদ্যোক্তা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সমগ্র উপজেলার ব্যাপক হারে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এখানে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে, তেমনই গড়ে উঠেছে ছোট ও মাঝারি অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানও।

আমরা সব সময় শিল্প স্থাপনে বিশ্বাসী। তাই এসব উদ্যোক্তাকে শিল্প স্থাপনে সহযোগিতা করছি। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বহু বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। সীতাকু-ের বাসিন্দা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব লায়ন আসলাম চৌধুরী এফসিএ বলেন, আমি নিজেও শিল্পোদ্যোক্তা।

×