
মানব পাচারের অপতৎপরতায় সক্রিয় হয়েছে পাচারকারী সিন্ডিকেট
অতীতের ন্যায় সাগরপথে ভয়ংকর দীর্ঘ যাত্রায় আবারও মানব পাচারের অপতৎপরতায় সক্রিয় হয়েছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। বরাবরের মতো এ পথে টার্গেটে রয়েছে বাংলাদেশে আশ্রিত সেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, অধিক রোজগার, উন্নত জীবন ও নানা সুযোগ-সুবিধার অলীকস্বপ্নে বিভোর হয়ে রোহিঙ্গারা মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ছে। অল্প টাকায় এ পথে পা বাড়িয়ে প্রকারান্তরে তারা অনিশ্চিত পথে পা বাড়াচ্ছে। মূলত রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্ট ও বাংলাদেশে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রিত রাহিঙ্গারা দুর্গম এ পথ ও মৃত্যুঝুঁকি পরোয়া করছে না। তাদের টার্গেটে থাকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এমনকি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়াও।
এ কাজে দালাল সিন্ডিকেট এতই সক্রিয় যে, হাত বদলের মাধ্যমে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকরা মূলত বিক্রিই হয়ে যায়। মাথাপিছু দরে এক দালাল অন্য দালালের কাছে এদের বিক্রি করে দেয়। দালালরা বিভিন্নভাবে হাত বদলের প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত এদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে ছাড় পায়। অতীতে এমনও ঘটনা ঘটেছে তলা ফুটো করে ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণহানি হয়েছে অনেকের।
ইন্দোনেশিয়া আচেহ প্রদেশের সমুদ্রসীমায় গিয়ে দালালচক্রের ইশারায় ট্রলার চালকরা তলা ফুটো করে দিলে ভাসমান থাকা অবস্থায় সে দেশের সরকার তাদের উদ্ধার করে আশ্রয় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে। এসব রোহিঙ্গা জেনেও সে পথে পা বাড়ায়। কারণ তারা জানে তাদের রাখাইনে বা বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানো হবে না। এক পর্যায়ে তারা থাকার অনুমতি পেয়ে যায়। এতেই তারা খুশি।
প্রধানত বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস সময়ে সাগরপথে মানব পাচারের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয় দালালচক্র। এমন সময়ের মধ্যে গত ৮ এপ্রিল সেন্টমার্টিন থেকে ৪৪ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এফভি কুলসুম নামের একটি মাছ ধরার ইঞ্জিনচালিত বোট থেকে ২১৪ রোহিঙ্গাকে আটক করে নৌবাহিনী জাহাজ দুর্জয়। এদের মধ্যে ২১৮ পুরুষ, ৬৮ নারী, ২৮ শিশু ছিল। এরা সকলেই মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ও উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় শিবিরে আশ্রিত।
এ ধরনের সাগরপথের যাত্রায় অধিকাংশ সময় দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে প্রাণ হারানোর রেকর্ড থাকা সত্ত্বে¡ও এরা ভয়কে থোড়াই কেয়ার করে। কারণ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া উপকূলে উদ্ধার হয়ে প্রথমে ক্যাম্প জীবন, পরবর্তীতে নানা কাজে সুযোগপ্রাপ্তির ঘটনা থাকে।
গত ৮ এপ্রিল উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জানা গেছে, জনপ্রতি ৩ থেকে ৪ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে তারা এ অনিশ্চিত যাত্রায় যাত্রী হয়েছে। কিন্তু গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত বড় ট্রলারে ওঠার আগেই ধরা পড়ে যায় তাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা। মূলত অবৈধ এ পথে যাত্রী হয়ে ধরা পড়লে দেশে তাদের কোনো শাস্তি হয় না। পুনরায় আশ্রয় ক্যাম্পে ফেরতই পাঠানো হয়।
এ ছাড়া দালাল চক্রের গড়ফাদাররা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফলে মানব পাচারের অবৈধ তৎপরতা থামছে না। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ইতোপূর্বে এ পথে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এমনকি অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়। এরাই রাখাইন ও বাংলাদেশে আশ্রিত স্বজনদের এ পথে যেতে উৎসাহ জোগায়।
এখানে একটি বিষয় উঠে এসেছে যে, রাখাইন রাজ্য থেকে যেসব রোহিঙ্গা এ অবৈধ পথে অতীতে ধরা পড়েছে তাদের অনেকের স্থান হয়েছে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পে। আশ্রিত হয়ে এদের থাকা ও খাবার সুযোগ হয়ে যায়। আর আশ্রয় ক্যাম্প থেকে যেতে গিয়ে যারা ধরা পড়ে তারাও পুনরায় একই ক্যাম্পে পুনর্বাসিত হয়। রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর। এরা ধরা পড়লে কী হবে, আর গন্তব্যে পৌঁছলে কী হবে সবকিছু তাদের জানা। অতীতে যারা চলে যেতে সক্ষম হয়েছে তারাই এদের উৎসাহ জোগায় বলে আশ্রিতদের অনেকেরই বক্তব্য রয়েছে।
এদিকে, কক্সবাজার জেলা ও পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ডের পক্ষে এ ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আছে বলে বরাবর বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এর পরও দালালচক্র ও রোহিঙ্গারা কিভাবে এ পথে সুযোগ খুঁজে নেয় তা নিয়ে নানা প্রশ্ন থেকে যায়। মানব পাচার নিয়ে মামলারও কমতি নেই। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়টি দৃশ্যমান হয় না।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১০ সালে টেকনাফ পয়েন্ট দিয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি জমিয়ে মানব পাচারের সূচনা ঘটে। এরপর কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রামে সাগর উপকূলবর্তী বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচারের ঘটনা দৃশ্যমান হতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় অনেকেই সফল হয়েছে। আবার অনেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। অনেকে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এমনকি ভারতের কারাগারে বন্দি জীবনে রয়েছে।
২০২৪ সালে সাগরপথে মানব পাচারের বড় কোনো ঘটনা ধরা পড়েনি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না তা কারও জানা নেই। মূলত উত্তাল সাগর নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শান্ত থাকে বলে এ সুযোগ মানব পাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই সময়ে দৃশ্যমান হলো গত ৮ এপ্রিল ২১৪ রোহিঙ্গা আটক হয়ে উদ্ধারের ঘটনা। এতে প্রতীয়মান পাচারকারী চক্র থেমে নেই। সুযোগ বুঝে এরা তৎপরতা চালায়। আইনশৃঙ্খলা কঠোর হলে এরা তৎপরতা সাময়িক বন্ধ রাখে। আবার সুযোগ বুঝে তৎপরতা শুরু করে।
এখানে আরও উল্লেখ্য, সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচার প্রক্রিয়ায় ট্রলারডুবিতে বর্তমান রেকর্ড অনুযায়ী ট্রলারডুবিতে ৪০০ শ’রও বেশি নিখোঁজের ঘটনা রয়েছে। এর পাশাপাশি পাচারকালে আটক হয়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের কারাগারে রয়েছে অসংখ্য। যাদের অধিকাংশ রোহিঙ্গা।