ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

এসো হে বৈশাখ উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে আবহমান প্রস্তুতি চলছে

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ১০ এপ্রিল ২০২৫

এসো হে বৈশাখ উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে আবহমান প্রস্তুতি চলছে

ছবি সংগৃহীত

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনবদ্য রূপ মৃৎশিল্প। এর সঙ্গে একদিকে জড়িয়ে আছে জীবনের প্রয়োজন, আর অন্যদিকে নান্দনিকতা ও চিত্রকলার বহিঃপ্রকাশ। যে কারণে এ শিল্প বাঙালির নিজস্ব শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অংশ।

বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে গ্রাম ও শহরে মেলাসহ নানান লোকজ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আর এসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাড়ে মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা। এতে মাটির তৈজসপত্র ও খেলনা তৈরিতে দেড়-দুই মাস আগে থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। এখন বৈশাখ ঘনিয়ে এসেছে। হাতে সময় মাত্র ৩ দিন। তাই কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি পাইকারি বিক্রিতে পালপাড়ায় ব্যবসায়ীরা ভিড় করছেন।

উত্তরাঞ্চলের বাহের দ্যাশের গ্রামীণ জনপদে আবহমান বৈশাখ ঘিরে তোড়জোড় চলছে। পালপাড়ার নারী-পুরুষের কর্মব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। মাটির তৈরি জিনিসপত্রে এখন দিন-রাত মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙ ছড়াচ্ছেন তাঁরা। মাটির খেলনাগুলোতে তাঁদের ছোঁয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে অনন্য আকর্ষণ। এ কাজে বড়দের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পালপাড়াগুলোর কিশোর-কিশোরীরাও।

এ অঞ্চলের নীলফামারী জেলার সোনারায়, চওড়া, রংপুর সদরের দক্ষিণ মমিনপুর ও বদরগঞ্জের মধুপুর পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, কুমার পরিবারের লোকজনের ব্যস্ততার শেষ নেই। বয়োজ্যেষ্ঠ কার্ত্তিক পাল বলেন, “বাপ-দাদার পেশা তাই বাধ্য হয়েই কাজ করছি। আগে মাটি-কাঠ ফ্রি পাওয়া গেলেও এখন সবই কিনতে হয়। এসব করে জীবন বাঁচানোই দায়। তবুও যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছি আমরা।” অপর্ণা পাল বলেন, “বৈশাখী মেলার জন্য মেম পুতুলের গায়ে লাল রং করছি। কিন্তু আমাদের জীবনে কোনো রং নেই।” তবে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখ ঘিরে পালপাড়াগুলোতে প্রাণ ফিরে এসেছে, সেটিও উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি জানান, মাটির তৈরি পুতুল, বাচ্চাদের খেলনা, নানা ধরনের ফুল-ফল, জীব-জন্তু, সবজিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র এক মাস ধরে তৈরি করা হয়েছে। বাচ্চাদের খেলনার মধ্যে টমটমের চাহিদা বেশি। মূলত ছোট ঠেলাগাড়ির আদলে তৈরি হয় টমটম। মাটির চাকার সঙ্গে বাঁশের লম্বা কাঠি বেঁধে দেওয়া হয় গাড়ির কাঠামো। রঙিন কাগজে মুখ মুড়িয়ে মাঝ বরাবর বসানো হয় মাটির পাত্র। চাকা ঘুরলে বিশেষ কায়দায় বেঁধে রাখা দুটি কাঠির আঘাতে সৃষ্টি হয় ‘টমটম’ শব্দ। এখন রং তুলিতে সাজিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। তাঁরা জানান, এখন প্রতিটি পরিবারে ঘরভর্তি মাটির পুতুল, খেলনা ও পশুপাখি থরে থরে সাজানো আছে। বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা উপলক্ষে পাইকাররা এসে তা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে।

সৈয়দপুরের কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের চওড়া পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, কুমার পরিবারের সদস্যরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করছে। গোপলা চন্দ্র পাল বলেন, “বৈশাখী উৎসবকে ঘিরে মাটির তৈরি জিনিস আগে থেকেই বানানোর কাজ চলে। মেলায় পুতুল, খেলনাসহ মাটির জিনিসের বেচাকেনা ভালো হয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের খেলনা, ফল-সবজি, থালা-বাসনের প্রতি ক্রেতাদের চাহিদা থাকে বেশি।”

একই এলাকার মৃৎশিল্পের নিপুণ কারিগর সুজন পাল বলেন, “যতই প্লাস্টিকের জিনিস বের হোক, মাটির তৈরি সামগ্রীর চাহিদা থাকবে যুগ যুগ। আমাদের তৈরি বড় আকারের ফুলদানি ঢাকা-চট্টগ্রামে বেশ বিক্রি হচ্ছে। সেখানে এর কারুকার্য করা ফুলদানির যথেষ্ট চাহিদা আছে।” সৈয়দপুর থেকে ট্রাকভর্তি মাটির পণ্য দেশের বিভিন্ন মেলায় বিক্রি হচ্ছে।

নীলফামারীর প্রায় ৪০০ মৃৎশিল্পী পরিবার এ শিল্পে জড়িত। এসব পরিবারের সদস্যরা কাদামাটি দিয়ে তৈরি করছেন বাহারি পণ্য। এসব পণ্য রোদে শুকানো, আগুনে পোড়ানো, রং করা ও প্যাকেট করে সরবরাহ করতে হচ্ছে। দূরদূরান্তের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নীলফামারীর মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় মাটির তৈরি শৈল্পিকতার ব্যাপক চাহিদা ও সুনাম রয়েছে। বৈশাখ ঘিরে উত্তরের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মেলার আয়োজক কমিটি থেকে তাঁদের পণ্য নিয়ে মেলায় যাওয়ার অনুরোধ পাচ্ছেন তাঁরা।

এবার মৃৎশিল্পীরা পণ্যের ডিজাইনে এনেছেন পরিবর্তন। মাটির ডিনার সেটে থাকছে— প্লেট, গ্লাস, মগ, কারিবল, জগ, লবণ বাটি, সানকি, কাপ-পিরিচ ও তরকারির বাটি। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে হাতি, ঘোড়া, গরু, হরিণ, সিংহ, বাঘ, ভালুক, জেব্রা, হাঁস, মুরগি। নতুন ডিজাইনে তৈরি হচ্ছে কয়েলদানি, মোমদানি, ফুলদানি, ঘটি-বাটি, আম, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, কামরাঙা, আতাফল, কলস, বাঙ্গি। এসবই বৈশাখী মেলায় ক্রেতাদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করবে।

নীলফামারী সদরের সোনারায় ইউনিয়নের পালপাড়ার মৃৎশিল্পী কার্তিক চন্দ্র পাল জানান, উৎসব ঘিরে পালপাড়াগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়লেও বাকি সময়গুলোতে বেকার থাকতে হয়। সৈয়দপুর উপজেলার কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের চওড়া পালপাড়ায় ৩০০ মৃৎশিল্পী পরিবারের বসবাস। এ পাড়ার স্বপন কুমার পাল জানান, শেষ সময়ে মৃৎশিল্পীরা বেশ ব্যস্ততায় দিন পার করছেন। মেলা ঘনিয়ে আসছে, তাই কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য পরিবারের সব সদস্যসহ বাড়তি শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছে।

মৃৎশিল্পী দীপ্তি রানি পাল বলেন, “বৈশাখীসহ বিভিন্ন মেলায় আমাদের পণ্য বিক্রি করে উপার্জিত অর্থ দিয়েই সন্তানেরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে। আমরা সিরামিক ও প্লাস্টিক পণ্যকে চ্যালেঞ্জ করে এখনো পালপাড়ার প্রতিটি ঘরে মাটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছি।”

তিনি আরও জানান, মাটি, রঙের দাম ও মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। “বৈশাখে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। এই মেলায় শখের বসে অনেকেই মাটির সামগ্রী কেনেন। তাই এই সময়ে আমাদের কিছুটা কর্মব্যস্ততা বাড়ে,” বলেন তিনি।

এই কাজে প্রয়োজন হয় এঁটেল মাটির। কিন্তু এখন মাটির অভাব। তার ওপরে রঙের দামও বেড়েছে। সে অনুযায়ী পণ্যের দাম ততটা বাড়েনি। এসব মাটির খেলনা ২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে বড় বড় ফুলদানিগুলো ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লানচু হাসান চৌধুরী বলেন, “পালপাড়ার কুমাররা ভালো ভালো কাজ করছেন। তাঁদের জন্য অবশ্যই পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এরা বংশ পরম্পরায় এসব কাজ করে চলেছেন।”

আশিক

×