
শেরপুর জেলায় প্রথমবারের মতো কফির উৎপাদন হয়েছে
সম্ভাবনার অনন্য সীমান্ত জেলা শেরপুরে এবার বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষে সফলতা এসেছে। এই সফলতার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে বিশেষ করে সীমান্তের গারো পাহাড়ে কফি চাষে দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি।
ফলে স্বাবলম্বী হতে কফি চাষে আগ্রহী ও আশাবাদী হয়ে উঠছেন স্থানীয় উদ্যোক্তা ও চাষিরা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কৃষি বিভাগের সহায়তায় কাক্সিক্ষত ফলন ও বাণিজ্যিক পথ সুগম হলে কফি চাষ স্থানীয় কৃষিক্ষেত্রে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে পারে। সে সঙ্গে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত কফি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত হতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
কৃষি ও খাদ্যসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরে প্রায় প্রতি বছরই নতুন নতুন ফসল নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এর মধ্যে তরমুজ ও কমলার পাশাপাশি বিদেশী ফল ড্রাগন, সাম্মাম ও চকলেট ফল কোকোয়ার চাষ অনেকটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নালিতাবাড়ী উপজেলার খালভাঙ্গা এলাকার কৃষি উদ্যোক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ জেলায় প্রথমবারের মতো কফি চাষ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
একসময় তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে বান্দরবান জেলায় কর্মরত ছিলেন। ওইসময় বান্দরবানের রুমা উপজেলার দার্জিলিংপাড়ায় কফি চাষ প্রথমে তার নজরে আসে। সেখান থেকেই কফি চাষ নিয়ে গবেষণা শুরু সাজ্জাদ হোসেনের। ওই গবেষণা তাকে কফি চাষে উদ্বুদ্ধ করলে তিনি ২০২১ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ওই এলাকার কফি চাষি লাল লিয়াং বং এর বাগান থেকে ৫ কেজি কফি কিনে নিজ এলাকায় এসে চারা উৎপাদন শুরু করেন।
সেই চারা পরীক্ষামূলকভাবে তার বাগানে রোপণের পর এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ফল দেওয়া শুরু হয়। কফি চাষে নিজে সফলতা পাওয়ার পর তিনি নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও পার্শ্ববর্তী হালুয়াঘাট উপজেলাসহ বান্দরবানের কিছু চাষির মাঝে বিনামূল্যে কফির চারা বিতরণ করেন। চারাগুলো থেকে পরিপূর্ণভাবে ফল দেওয়া শুরুর পর উৎপাদিত কফি তুলিপ নিজেই সংগ্রহ করে নিজস্ব মেশিনে রোস্টিং করে বাজারজাত করছেন। এতে তিনি সফলতার মুখ দেখছেন।
ওই সফলতা দেখে প্রতিদিন নিজ জেলার বিভিন্ন এলাকার চাষিরা এসে কফি গাছের চারা নিয়ে যাচ্ছেন। কেবল তাই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা ও প্রান্ত থেকেও কুরিয়ারের মাধ্যমে তার কাছ থেকে চারা সংগ্রহ করছেন অনেকেই। এতে লাভের আশায় চাষিরাও দারুণভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সাম্প্রতিক বিশ্বে ৬০ প্রজাতির কফির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তবে বাণিজ্যিকভাবে এরাবিকা ও রোবাস্টা জাতের দুই রকমের কফির চাষ হয়ে আসছে। আবহাওয়ার পাশাপাশি শেরপুরের গারো পাহাড় ও সমতল এলাকার মাটি কফি চাষের উপযোগী হওয়ায় এখানে বাণিজ্যিকভাবে ওই দুই জাতের কফি চাষ শুরু হয়েছে। তবে রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বেশি উপযোগী।
চারাগুলো দেখতে কিছুটা দেবদারু চারার মতো। মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে প্রতিটি পরিপক্ব গাছে ফুল ধরা শুরু হয়। মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল থেকে গুটি গুটি ফলে পরিণত হয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফল পরিপক্বতা লাভ করে। পরে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। বাজারজাত পানের উপযোগী করতে কফি বীজ মেশিনের মাধ্যমে রোস্টিং করতে হয়। এরপর প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কফি বাজারজাতকরণের উপযোগী করা হয়।
আবার কফির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায়। ফলন ভালো হলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গাছপ্রতি ৫/৭ কেজি কফি পাওয়া সম্ভব। প্রতি কেজি পরিপক্ব কফি ফলের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা। প্রতি একরে ২৫০/৩০০টি গাছ লাগানো যায়। সেই হিসাবে বছরে ২০০ কফি গাছ থেকে ১ হাজার ৬০০ কেজি পর্যন্ত কফি ফলন পাওয়া যায়। যার ন্যূনতম বাজারমূল্য ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রক্রিয়াজাতের পর প্রতি কেজি কফি ২ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ২শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গেলে কথা হয় উদ্যোক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপের সঙ্গে। তিনি জানান, বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এই অঞ্চলে গারো পাহাড়ে প্রচুর অব্যবহৃত জমিকে চাষের আওতায় আনতে আগামী দুই বছরে প্রায় দুই লাখ চারা বিনামূল্যে দেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত শতাধিক চাষির মাঝে ২৫ হাজার চারা বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন।
চারাগুলো আগামী ২ বছরের মাথায় ফল দেওয়া শুরু করবে। এ ছাড়া তিনি উপজেলা কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় কফি চাষিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চারা রোপণ ও পরিচর্যার বিষয়ে অবহিত করছেন। একইসঙ্গে সহায়ক হিসেবে একটি করে বই দিচ্ছেন। তিনি আরও জানান, কফি চাষে বাড়তি কোনো জমি লাগে না। বাড়ির যে কোনো বাগানে সাথী ফসল হিসেবে ছায়াযুক্ত জায়গাতে কফি চাষ করে বাড়তি আয় করছেন চাষিরা।
উৎপাদিত কফি বিক্রি করার জন্য কৃষকদের কোথাও যেতে হচ্ছে না। তিনি নিজেই ন্যায্যমূল্যে কফি কিনে নিচ্ছেন। এতে কৃষকরা বাজারজাতকরণ ও সঠিক দাম পেয়ে খুশি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এই কফি রপ্তানি করবেন। কেন বিনামূল্যে কফির চারা বিতরণ করেন এমন প্রশ্নে উদ্যোক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ বলেন, নতুন ফসল হিসেবে কৃষকরা ঝুঁকি নিতে চান না।
তাই তিনি নিজ উদ্যোগে চাষিদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করছেন। চারাগাছ থেকে যখন কফি উৎপাদন শুরু হবে তখন তিনি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে কফি কিনে নিয়ে বাজারজাত করবেন।
তার বাগানে আসা পার্শ্ববর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার কড়ইতলি গ্রামের কৃষক মনির হোসেন বলেন, অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা জাতের ৪শ কফির চারা রোপণ করেছিলাম। এ বছর প্রায় আড়াইশ গাছে কফি ফল এসেছে। আশা করছি প্রতিটি গাছ থেকে ৩ থেকে ৪ কেজি কফি বিক্রি করতে পারব।
নালিতাবাড়ী উপজেলার শিক্ষার্থী সাদিকুর রহমান খোকা বলেন, আমি ২শ কফির চারা নিয়ে বাড়ির আশপাশে রোপণ করেছি। একইসঙ্গে কফি চাষের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। আশা করছি বছরখানেকের মধ্যে আমার গাছে ফল আসবে। স্থানীয় আতিকুর রহমান বলেন, কফি চাষ করতে তুলিপ ভাই বিনামূল্যে চারা দিয়েছেন। এ ছাড়া কৃষি বিভাগ থেকেও সবধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। কফি চাষে তেমন কোনো খরচ না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হওয়া সম্ভব বলে আশা করছি।
এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, জেলায় প্রথমবারের মতো কফি চাষে সফলতার মুখ দেখিয়েছেন উদ্যোক্তা সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ। তার হাত ধরেই কফি চাষ এগিয়ে নিতে কৃষি বিভাগের তরফ থেকে তাদের প্রশিক্ষণসহ সবধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কফি ফল থেকে বীজ আলাদা করতে কয়েকটি যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
এতে কফি চাষিরা সহজেই বীজ সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বাজারজাত করতে পারছেন। তার মতে, গারো পাহাড়ের মাটির অম্লত্ব ও উর্বরতা শক্তি কফি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বৃষ্টিপাত ও মাটির গঠন বিন্যাস মিলে এ অঞ্চলে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।