
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে চলছে আশা-নিরাশার দোলাচল
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে চলছে আশা-নিরাশার দোলাচল। ইতোপূর্বে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সদিচ্ছা ও কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বছরের পর বছর ধরে প্রলম্বিত হয়ে আছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টির সমাধানে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান উপদেষ্টার হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান মঙ্গলবার জানান দিলেন আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরাতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ চালাচ্ছে, আলোচনায় বসবে।
সরকার পক্ষের এ বক্তব্য অবশ্যই ইতিবাচক দিক বলে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে আলোচিত হচ্ছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকেও বলা হয়ে থাকে, তারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়। তবে তাদের শর্ত রয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে নাগরিকত্ব প্রদান। এছাড়া রয়েছে, ফেলে আসা ভিটেবাড়ি ফেরত পাওয়া, ফিরে গিয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ পাওয়া ইত্যাদি।
অপরদিকে, জান্তা সরকার অতিসম্প্রতি জানান দিল তারা ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে উপযুক্ত বলে চিহ্নিত করেছে। আরও ৭০ হাজারের তালিকা যাচাই বাছাই চলছে। এছাড়া আরও ৫ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই করা হবে। অর্থাৎ সবমিলে ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা তাদের হাতে রয়েছে। যা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা এর চেয়ে আরও বহু বেশি। অর্থাৎ আরও ৭ লাখ রয়েছে। এদের বেশিরভাগ নিবন্ধিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সংখ্যায় যাই হোক-প্রত্যাবাসন শুরু করাটাই মূল কথা। কেননা, অতীতে মিয়ানমার চুক্তি করেও তা কার্যকরে এগিয়ে আসেনি। এখন যখন রাখাইন রাজ্য তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে তখন প্রত্যাবাসনে জান্তা সরকারের ইচ্ছার বিষয়টি সফলতার মুখ দেখবে কিনা সেটি বিবেচ্য। সফলতার দিক নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। কেননা, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তরেখা ২৭১ কিলোমিটার।
এর পুরোটাই বর্তমানে সে দেশের বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং আরাকান আর্মির সবুজ সঙ্কেত পাওয়া না গেলে প্রত্যাবাসন অধরাই থেকে যাবে। এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে যত কথাই বলা হোক না কেন বর্তমান পরিস্থিতিতে এর ফলাফল শূন্যই থেকে যেতে পারে। বাংলাদেশে যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে তারা সকলেই রাখাইন রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা।
প্রত্যাবাসনে ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে চুক্তি ও আলোচনা হওয়ার পরও তা সফল হয়নি। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও মিয়ানমার সরকারকে নানাভাবে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। সর্বশেষ গত ১৪ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেন। এ সময় রোহিঙ্গা নেতাদের পক্ষে জাতিসংঘের উদ্যোগে সেফজোন প্রতিষ্ঠার কথা জানানো হয়।
অন্যথায় প্রত্যাবাসন নয় বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। একইদিনে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও উখিয়ায় গিয়েছিলেন। তিনি রোহিঙ্গাদের বিশাল সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, আগামী ঈদ যাতে তারা নিজ দেশে করতে পারেন সে চেষ্টা তিনি চালাচ্ছেন। ওইদিন রোহিঙ্গারা আপ্লুত হয়েছেন। কিন্তু প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজতরভাবে হওয়ার পথটি বন্ধুর একটি প্রক্রিয়া।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে সেইফজোন প্রতিষ্ঠা ছাড়া রোহিঙ্গারা ফিরে যদি যায়ও সেখানে তাদের নিরাপত্তা কে দেবে ? এছাড়া নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটেবাড়ি ফেরতের দাবি তো রয়েছেই। এসব দাবি কীভাবে মেটানো হবে।
এ অবস্থায় প্রত্যাবাসনে মূল অন্তরায় আরাকান আর্মি। সেক্ষেত্রে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ আলোচনা করে একটি ইতিবাচক দিক সৃষ্টি করতে পারলে তাতে আশার আলো নিশ্চিতভাবে দেখা দেবে। এরপর যদি রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে উদ্যোগী হয় তাতেই শুরু হবে বহুল কাক্সিক্ষত প্রত্যাবসন প্রক্রিয়া।
প্রত্যাবাসনে আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে বিশ্বের শক্তিশালী দেশসমূহের এ ব্যাপারে মত পাওয়া। বিষয়টিকে খুব সহজ বলা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেকরা। কেননা, আশ্রিত রোহিঙ্গারা এ দেশে শান্তির পরিবেশে রয়েছে। দেশী-বিদেশী খাদ্যসহ অন্যান্য সহযোগিতায় নিরবচ্ছিন্নভাবে দিনাতিপাত করছে। এসব নিশ্চয়তার বলয় থেকে তারা আবার অনিশ্চিত পরিবেশে যাবে কি না সেটা নিয়েও রয়েছে বড় একটি প্রশ্ন।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আরাকান আর্মির সঙ্গে বসবে বাংলাদেশ ॥ আগামী ঈদ যেন রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে করতে পারেন সে লক্ষ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান। মঙ্গলবার ঢাকার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ড. খলিলুর রহমান এ কথা জানিয়েছেন।
তিনি জানিয়েছেন, মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে। এখানে একটি বড় অগ্রগতি হয়েছে। মোট ছয় কিস্তিতে ৮ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চায় মিয়ানমার। আরও ৭০ হাজারের বিষয়ে রিভিউ চলছে। এছাড়া বাকি ৫ লাখ ৫০ হাজারের বিষয়ে পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ হচ্ছে বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, প্রত্যাবাসনের কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর প্রথম ধাপের রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হবে। এ বিষয়ে আলোচনা চলছে আরাকান আর্মির সঙ্গে। তারাও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেরানোর ব্যবস্থা হবে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সঙ্গে আরাকান রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গারা যাতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হন সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। জেনে বুঝে তাদের আগুনে ফেলে দেওয়া যাবে না। তিনি জানান, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগে মধ্যস্থতা করছে জাতিসংঘ।