
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোর জনগণের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য চলমান। মিডিয়ার বদৌলতে পাহাড়ে চাকমা আধিপত্যবাদের চর্চা সুপ্রতিষ্টিত সত্য। তাদের অত্যাচার থেকে মুক্তির দোহাই দিয়ে গঠিত হলো বম-খিয়াংদের কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট- কেএনএফ এর মতো সন্ত্রাসী সংগঠন। হঠাৎ করে সেই বমদের জন্য রাস্তায় নেমে চাকমা সম্প্রদায়ের এক মহিলা নেত্রী গলা ফাটালেন। ব্যাপারটি অভূতপূর্ব এবং একইসাথে বিস্ময়কর!
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি খবরের দিকে নজর দিলে বিষয়টি আরও চমকপ্রদ ঠেকতে পারে। বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্প্রতি সরকারি খাদ্যশস্য ও নগদ অর্থ বরাদ্দে বৈষম্যপূর্ণ আচরণের খবর ছাপা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার নেতৃত্বে ২০২৫ সালের খাদ্যশস্য ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে, তা এই অঞ্চলের সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।
খবরে বলা হয়েছে, বরাদ্দের ক্ষেত্রে চাকমা জনগণ তাদের জনসংখ্যার তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি সুবিধা পেয়েছে। চাকমা জনগণের জন্য বরাদ্দের হার প্রথমে ধাপে ছিল ৬১.২৫%, যা তাদের জনসংখ্যার ২.৩৪ গুণ বেশি। পরবর্তীতে নগদ বরাদ্দে ৭৪.৪৩% (২.৮৪ গুণ বেশি) এবং তৃতীয় বরাদ্দে ৯৪.৭৭% (৩.৬১ গুণ বেশি) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, বাঙালি জনগণ, যারা মোট জনসংখ্যার ৫০% অধিক, বরাদ্দ পেয়েছে তার মাত্র ৪-১৭%—একটি স্পষ্ট বৈষম্য। মারমা, ত্রিপুরা এবং বমসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্যের তুলনায় অত্যন্ত কম বরাদ্দ পেয়েছে।
এটা নিয়ে চাকমা ওই নেত্রী বা অন্য কাউকেই কথা বলতে দেখা যায়নি। কিন্তু ঠিকই ২০২৪ সালে কেএনএফ'র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে আটককৃতদের মুক্তির দাবিতে প্লেকার্ড হাতে এসে প্রতিবাদ করে মিডিয়ার ফোকাস পেতে মরিয়া হয়ে উঠলেন রানী ইয়েন ইয়েন। তিনি মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বান্দরবান কারাগারের সামনে কিছু পরিচিত সাংবাদিক ডেকে সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন এক দাবি নিয়ে নিয়ে। তার দাবি,২০২৪ বান্দরবানের বম অধ্যুষিত বেথেল পাড়া থেকে আটককৃতদের মুক্তি দিতে হবে। পাহাড়ের আরেক সশস্ত্র সংগঠন জনসংহতি সমিতি- জেএসএস (সন্তু) এর মুখপাত্রে তার অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেএনএফ'র মতো সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বান্দরবানের পুরো বম জাতির উপর সমষ্টিগত শাস্তির খরগ চালিয়েছে সেনাবাহিনী।
মাত্র শ’খানেক সদস্যের কেএনএফকে দমনে ব্যর্থ হয়ে রুমায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় নারী ও শিশুদের পর্যন্ত জেলখানায় আটক করে রাখা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর জামিনে মুক্ত হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিম উদ্দীন রাহমানীসহ ছয় জন শীর্ষ সন্ত্রাসী। অথচ এক বম নারীর একাধিকবার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে। বিগত সরকারদের আমলে বিভিন্ন মামলায় আটক ও দণ্ডপ্রাপ্ত ড.মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজন, তারেক রহমানসহ আটজন, খালেদা জিয়াসহ চারজন, মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত জাকারিয়া পিন্টুসহ ৩ বিএনপি নেতাকর্মী, মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত লুতফুজ্জামান বাবরসহ পাঁচজন বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অথচ বম জাতির উপর সমষ্টিগত শাস্তির অংশ হিসেবে কেএনএফ এর ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনার প্রেক্ষিতে কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণের বালাই ছাড়াই জেলে আটক বম নারী ও শিশুদের মুক্তি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোন বিকার নেই।
এমনকি জাতিসংঘে অন্তর্বর্তী সরকারের নারী অধিকার সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন—“আমি জবাব চাই!”
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এতদিন নিরব থাকা ইয়েন ইয়েনের এই আচমকা 'বমপ্রীতি'র পেছনে উদ্দেশ্য কী?
বিভিন্ন মহলের ধারণা, এটি আসলে একটি সুচারু রাজনৈতিক কৌশল। চাকমা আধিপত্য নিয়ে যেসব বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা হতে পারে এটি। পাহাড়ে তাদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে হলে কখনো কখনো প্রতিপক্ষ জনগোষ্ঠীর পক্ষেও নাটকীয়ভাবে কিছু বলা দরকার হয়।
রানী ইয়েন ইয়েনের ব্যক্তিগত পরিচয়ও এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি 'রানী' পদবি ব্যবহার করলেও আসলে তিনি চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়ের ২য় স্ত্রী এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানে পলায়নকারী সাবেক সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায়ের পুত্রবধূ। অতীতেও তাকে নিয়ে নানা সময় সাম্প্রদায়িক উসকানি ও দেশবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে।
চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, এই নাটকীয় মানবাধিকার চেতনার জাগরণ ঘটে এমন এক সময়ে, যখন আগামী ২১ এপ্রিল থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে আদিবাসী ইস্যুতে স্থায়ী ফোরামের ২৪তম সেশন শুরু হতে যাচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য- “জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কর্মপদ্ধতির মধ্যে আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘ ঘোষণা বাস্তবায়ন”।
এই সেশনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই কিছু উপজাতি নেতা দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, এবং সরকারের মানবাধিকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার কৌশল নিচ্ছেন বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
সুতরাং, ইয়েন ইয়েনের বোমা ফাটানো ‘বম-ভালোবাসা’ যদি আদতে একটি কৌশল হয়, তবে তা খুবই সূক্ষ্ম এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পরিকল্পনার অংশ হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের সতর্ক থাকা আবশ্যক। একইসাথে গণমাধ্যমের দায়িত্ব—এই ধরণের কৌশলী চক্রান্ত বা মতলববাজির পর্দা উন্মোচন করা, যেন দেশবিরোধী এজেন্ডা কোনোভাবেই সাফল্য না পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে, কেবল একজনের কণ্ঠ নয়-সব জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
গোলাম যাকারিয়া ,লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আফরোজা