ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২

হোমনার বাঁশি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও জনপ্রিয়

শামীম রায়হান, হোমনা থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ৯ এপ্রিল ২০২৫

হোমনার বাঁশি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও জনপ্রিয়

দাউদকান্দির হোমনার বাঁশির গ্রামে বাঁশি তৈরির কাজে ব্যস্ত গৃহবধূ

কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ছোট গ্রাম শ্রীমুদ্দি এখন বাঁশির গ্রাম নামে পরিচিত। এসব হাতে তৈরি বাঁশি যাচ্ছে দেশের গ-ি পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এতে এ অঞ্চলের মানুষ এক নামে চেনেন বাঁশির গ্রাম হিসেবে।

হোমনা সদর থেকে প্রায় আড়াই কিমি দূরে তিতাস নদীর পাশে অবস্থিত শ্রীমদ্দি গ্রামে বাঁশি পল্লিতে শেষ সময়ের ব্যস্ততম সময় পার করছেন বাঁশির কারিগররা। কয়েকদিন পরেই নববর্ষ। আর নববর্ষ মানেই বৈশাখী মেলা। আর বৈশাখী মেলা মানেই বাঁশির কদর একটু বেশিই। তাই শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশিপল্লিতে তৈরি হচ্ছে নানান রকমের বাঁশি। মেলায় বাঁশির জোগান দিতে ব্যস্ত পল্লির সবাই।
ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশির ব্যবহার দিনে দিনে কমে এলেও অত্র গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবারেরও বেশি বাঁশি শিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে পাল্টে দিয়েছেন গ্রামের দৃশ্যপট। একমাত্র বাঁশি তৈরি করে এখানকার অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। নতুন বছরের মেলায় বাঁশির জোগান দিতে দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছে এসব পরিবারের সদস্যরা। বাঁশি তৈরি করে এখন সচ্ছল জীবন-যাপন করছে অনেকেই। শুধু তাই নয় এ বাঁশি পল্লি থেকে বছরে প্রায় কোটি টাকার বাঁশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শ্রীমদ্দি পুরো গ্রামটি ঘুরে চোখে পড়েনি বেকার কোনো যুবক-যুবতীর দুঃখময় চেহারা। গ্রামের প্রায় সব বাড়ি দোচালা ঘরের। সারা গ্রামে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ও অলিগলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন রকমের ডিজাইনের বাঁশি।

নারী-পুরুষ-শিশুসহ সব বয়সের মানুষই বাঁশি শিল্পের বিভিন্ন ডিজাইন তৈরি করতে নিয়োজিত। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর পাশাপাশি তাদের সন্তানেরাও পিছিয়ে নেই। প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজের ফাঁকে সময় অনুযায়ী বাঁশি তৈরি করছে। এভাবে কাটছে  গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের জীবনধারা। এখান থেকেই বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি তৈরি পণ্য চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় মার্কেটে।
এদিকে তাদের পরিবারের নতুন প্রজন্মের অনেকে বাঁশি তৈরির পেশা থেকে সরে যাচ্ছে। আবার বাঁশি তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এই পেশা। কালের বিবর্তনে বাঁশির চাহিদাও কমছে বলে মনে করেন কারিগররা। কয়েকজন কারিগর জানান, বর্তমানে কয়লার দাম বেশি হওয়ার কারণে এই শিল্প থেকে দিনের পর দিন অনেকে সরে দাঁড়াচ্ছে।
হোমনার শ্রীমর্দ্দি গ্রামের বাঁশি পাড়ার ১০ বছর থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বৃদ্ধ ও নারী-পুরুষ থেকে স্কুলগামী শিশুরাও বাঁশি তৈরির কাজ করে থাকে। বাঁশিতে নকশা তৈরি, ছিদ্র করা, ধোয়া-শুকানো এবং রং করার কাজ নারীরা বেশ আগ্রহ নিয়ে করে থাকেন।
বাঁশি তৈরির কারিগর শ্রীমদ্দি গ্রামের মৃত রেজাউল মিয়ার ছেলে জজ মিয়া (৪৫) বলেন, দৈনিক আমরা ১শ বাঁশি তৈরি করি। তাদের গ্রামে বাঁশি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে কবে তা তিনি সঠিকভাবে না বলতে পারলেও তিনি জানান, আমাদের দাদা-বড়দাদার আমল থেকে এ বাঁশি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। সে থেকে এই বাঁশি শিল্পের সঙ্গে জড়িত আমরাও।

তা ছাড়া এই কাজ খুবই সহজ। ফাল্গুন মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত অধিক বাঁশি তৈরি ও বিক্রি হলেও শ্রীমদ্দি গ্রামের শিল্পীরা সারা বছরই বাঁশি তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন এসে এখান থেকে পাইকারি দরে বাঁশি কিনে নিয়ে যায়।
বাঁশির কারিগর মৃত সোলেমান মিয়ার ছেলে আবুল কাশেম (৬০) দুঃখ নিয়ে জানান, একশ থেকে দেড়শ বছর ধরে চলছে বাঁশি তৈরির কাজ। বর্তমানে পূর্বসূরিদের দেখানো পথে এখনো অন্তত অর্ধশতাধিক পরিবার বাংলার ঐতিহ্য লালন করতে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে বাঁশি তৈরির কাজ।

প্রতিটি বাঁশির খুচরা মূল্য ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। এ ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ২০-২৫টি দেশে এই বাঁশি শিল্পের খ্যাতি রয়েছে, এ গ্রাম থেকে যায় বাঁশি। কথা বলে জানা গেছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ বাঁশি তৈরি হয় হোমনার শ্রীমদ্দিতে। 
তিনি আরও বলেন, আমরা চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড ও মিরসরাই থেকে মুলি বাঁশ কিনে ট্রাকযোগে নিয়ে আসি শ্রীমদ্দি গ্রামে। পরে বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী মুলি বাঁশ কেটে টুকরা টুকরা করা হয়। এরপর টুকরাগুলো রোদে শুকিয়ে ফিনিশ করে লোহা কয়লা দ্বারা গরম করে মাপ অনুযায়ী বাঁশে ছিদ্র করা হয়। এবং মান্দাল কাঠ দিয়ে কডি তৈরি করে বাঁশের মাথায় আটকিয়ে দেওয়া হয় এবং বাঁশের কভারে রং দ্বারা বিভিন্ন ডিজাইন করে বাজারজাত করা হয়। আমরা প্রায় ১৫ ধরনের বাঁশি তৈরি করে থাকি।

এগুলোর মধ্যে তোতা (মুখ) বাঁশি, মোহন বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, খানদানি বাঁশি, আর বাঁশি (ক্লাসিক্যাল সুরের বাঁশি), বীণ বাঁশি, বেলুন বাঁশি রয়েছে। বিদেশের অনেক দেশেই বাঁশির কদর অনেক বেশি। কারণ এ বাঁশি একেবারেই প্রাকৃতিক। আমাদের দেশে বংশীবাদকের কাছে খানদানি বাঁশির কদর অনেক বেশি। তবে লম্বা, মোটা নিখুঁত কাজের ওপর বাঁশির দাম নির্ভর করে। কিন্তু বাচ্চাদের মুখ বাঁশি তৈরি ও বিক্রি হয় বেশি।
শ্রীমদ্দি গ্রামের যতীন্দ্র বিশ্বাস ও তার স্ত্রী রিনা বিশ্বাস নকশা করা বাঁশি তৈরি করেন। স্বামী-স্ত্রী দুইজনে মিলেই নকশি করা বাঁশি তৈরি করে এক্সপোর্টের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, লন্ডন, জাপান, কানাডা, জার্মান, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেন বলে তিনি জানান। রিনা বিশ্বাস ৩ সন্তানের জননী। সারাক্ষণ গৃহ ও নকশা করা বাঁশি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন। তবুও তার মুখে হাসি।

বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের বৈশাখী মেলা ছাড়াও হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালী বাড়ীর মেলা, দাউদকান্দির আইনুদ্দিন শাহ মেলা, কচুয়ার সাচারের রথমেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের বেলতুলীর লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলা, লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী ¯œান, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়ার লালন শাহ মেলা, তিতাসের গাজীপুরে মৌসুমি বাঁশি বিক্রি ছাড়াও প্রায় সারা বছরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শহর, বন্দর, হাট-বাজারে তারা তাদের বাঁশি বিক্রয় করে থাকে। 
বাঁশির আরেক কারিগর অনিল বিশ্বাস বলেন, শ্রীমদ্দিতে ব্রিটিশ আমল থেকে বাঁশি তৈরি করে আসছি। ১০-১২ বছর বয়স থেকেই এ কাজ করছি। কিন্তু আমরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সুদমুক্ত কোনো ব্যাংকঋণ পাই না।

আরো পড়ুন  

×