ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২

বাহা উৎসবে নাচে গানে উচ্ছল সাঁওতাল পল্লী

নিজস্ব সংবাদদাতা, গোবিন্দগঞ্জ ও গাইবান্ধা

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ৮ এপ্রিল ২০২৫

বাহা উৎসবে নাচে গানে উচ্ছল সাঁওতাল পল্লী

গাইবান্ধায় বাহা বা ফুল উৎসবে সাঁওতালদের নৃত্য

বাহা বা  ফুল উৎসব আসলে সৃষ্টির উৎসব। বসন্তকালে গাছে গাছে পাতা, মুকুল প্রস্ফুটিত হয়; ফুল ফোটে। শাল, পলাশের ফুলে ভরে ওঠে জঙ্গল। এই ঋতুতে যে ফুল ও পাতা গজায় তাকে ব্যবহারের আগে প্রকৃতির সেই নতুন সৃষ্টিকে সম্মান জানাতেই এই বাহা উৎসব পালিত হয়। মঙ্গলবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন নাচে গানে মেতে ওঠেন বাহা উৎসব উদ্যাপনে। বাহা পরব উপলক্ষে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লি সেজে ওঠে বসন্তের রঙিন সাজে।  
আপন ঐতিহ্য রক্ষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি সমুন্নত রাখতে বাহা পরবে মেতেছিল সাঁওতাল গ্রামগুলো। ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করতে উপজেলার সাঁওতাল সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের পূজা অর্চনা,নাচ,গান আর নানা আয়োজন করেছিলেন এই উৎসবকে ঘিরে।  
উপজেলার কামদিয়া ইউনিয়নের তল্লাপাড়া গ্রামে সেভেন ডে অ্যাডভেন্টিস্ট প্রি সেমিনারি স্কুল প্রাঙ্গণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড এবং আর্টিকেল নাইনটিনের সহযোগিতায় ও অবলম্বনের আয়োজনে বাহা পরব বা বসন্ত উৎসব উদ্যাপন করেন সাঁওতালরা। দিনভর ধর্মীয় পূজা-অর্চনা ও সাঁওতাল সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনায় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সাঁওতাল নারী-পুরুষ ও কিশোরীরা অংশগ্রহণ করেন। 
বাহা পরব উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক জেমস সরেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মাননীয় অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা, পরিবেশ আন্দোলন-গাইবান্ধার আহ্বায়ক ওয়াজিউর রহমান রাফেল, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম, গাইবান্ধা প্রেস ক্লাব সভাপতি অমিতাভ দাশ হিমুন, অবলম্বনের নির্বাহী পরিচালক প্রবীর চক্রবর্তী, আইপি নিউজের চিফ এডিটর এ্যান্থনি রেমা, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ সদর উপজেলার আহ্বায়ক গোলাম রব্বানী মুসা, অবলম্বনের এ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর টনি চিরান, ব্রিটিশ সরেন, মাহবুব মুকুল, সাবিনা টুডু, সুরভী মার্ডি, অঞ্জলী রানী দেবী, নাজমা বেগম, সেলিনা আকতার সোমা, সাজেদা পারভীন রুনু, মনির হোসেন সুইট প্রমুখ। 
আলোচনায় বক্তারা বলেন, সাঁওতালরা এ দেশেরই নাগরিক। তাদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য আমাদের দেশের সংস্কৃতিরই অংশ। সাঁওতালদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ, সাঁওতালসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষাদান ও কালচারাল একাডেমি স্থাপন করার দাবি জানান তারা। 
আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে স্থানীয় সরকার কাঠামোতেও এসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আলোচকরা বলেন, পরিবেশ, বনায়ন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ ভেষজ চিকিৎসার ক্ষেত্রে যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ আদিবাসী জ্ঞান গ্রহণ এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে আদিবাসীরা সরকার ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবহেলার শিকার এবং এসব জ্ঞান ও তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে এখনই প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি কার্যকর উদ্যোগ। 
বাহা পরব আয়োজক সংগঠন অবলম্বনের নির্বাহী পরিচালক প্রবীর চক্রবর্তী বলেন, প্রাণ-প্রকৃতিকে ভালোবেসে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বাহা উৎসব পালন করে। ভবিষ্যতে যাতে এই ঐতিহ্যবাহী বাহা পরব হারিয়ে না যায়, সেজন্য নতুন প্রজন্মকে জানাতেই এই উৎসব আয়োজন।
উল্লেখ্য, আদিবাসী সাঁওতালদের অন্যতম একটি প্রধান পার্বণ হচ্ছে ‘বাহা উৎসব’ বা বাহা পরব। বাহা অর্থ ফুল। তাই বাংলায় বাহা পরবকে ‘ফুল উৎসব’ বলা হয়। মূলত, নববর্ষ হিসেবে ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করে সমতলে বসবাসকারী ‘আদিবাসী’ সাঁওতালরা। উত্তরাঞ্চলে সমতলে বসবাসকারী ‘আদিবাসী’ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ওঁড়াও, মুন্ডা, মালো, মাহাতো, মালপাহাড়ী, রাজওয়ারসীসহ মোট ৩৮টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এই বাহা উৎসব পালন করে থাকে।

আরো পড়ুন  

×