
প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে হিমালয়ের অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে বাবর আলী
এভারেস্ট জয়ী চট্টগ্রামের বাবর আলী এবার পৃথিবীর দশম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ অন্নপূর্ণা-১ জয় করলেন। প্রথম কোনো বাংলাদেশী হিসেবে তিনি হিমালয়ের এই শৃঙ্গে আরোহণ করলেন। বিশ্বের দশম শীর্ষ এবং কঠিন পর্বত হলো অন্নপূর্ণা। এ পর্বতের উচ্চতা ২৬ হাজার ৫৪৫ ফুট। এর শীর্ষে প্রথমবার উড়ল লাল-সবুজের পতাকা।
অভিযানের আয়োজক সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স সভাপতি ও অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান জনকণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সোমবার ভোরে অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান বাবর আলী। এই অভিযানের আউটফিটার মাকালু অ্যাডভেঞ্চার-এর স্বত্বাধিকারী মোহন লামসালের সূত্রেই এই তথ্য প্রাপ্তি। এ ছাড়াও অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে বাবরের সঙ্গী ছিলেন ক্লাইম্বিং গাইড ফূর্বা অংগেল শেরপা।
বাবরের সংগঠন এবং এই অভিযানের আয়োজক পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে সোমবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘লাখো শুভাকাক্সক্ষীর প্রার্থনার উত্তর দিয়েছেন ¯্রষ্টা। প্রকৃতিমাতা বিমুখ হননি। বঙ্গসন্তান বাবরকে ক্ষণিকের জন্য নিজের চূড়ায় দাঁড়াতে দিয়েছে অন্নপূর্ণা। বাবর আলী সুস্থাবস্থায় ক্যাম্প-৩ এ নেমে এসেছেন। যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়।
বাবরকে সোমবারের মধ্যে নেমে আসতে হবে ক্যাম্প-২ এর নিরাপত্তায়। আর মঙ্গলবার নামতে হবে বেস ক্যাম্পে। আর জানেনই তো চড়ার চেয়ে নামা অধিক ঝুঁকির। ওই বিপদসংকুল এলাকাতে যোগাযোগ সম্ভব নয়। তাই শীর্ষের ছবি ও ভিডিও প্রাপ্তি আপাতত সম্ভব নয়। তাই বাবরের নিরাপদ অবতরণের জন্য চলুক প্রার্থনা। এরপরই হবে উৎসব।’
উল্লেখ্য, ২৪ মার্চ বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালে যান। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ২৬ মার্চ কাঠমান্ডু থেকে বিমানে উড়ে যান পোখারা। এরপর কিছু পথ গাড়িতে ও বাকি পথ হেঁটে ২৮ মার্চ পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে। অন্নপূর্ণাতে সবকিছুই বেশ দ্রুতলয়ে ঘটে। একদিন বিশ্রাম নিয়েই পরদিন চড়তে শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। ক্যাম্প-১ (৫২০০ মিটার) এ দুই রাত এবং ক্যাম্প-২ এ (৫৭০০ মিটার) এক রাত কাটিয়ে ২ এপ্রিল বাবর নেমে আসেন বেসক্যাম্পে।
তুষারঝড়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে অন্নপূর্ণা জয় ॥ ভারি তুষারপাতের কারণে অন্নপূর্ণা অভিযান সবসময় কঠিন। তার ব্যতিক্রম ছিল না বাবরের ক্ষেত্রেও। অন্নপূর্ণা জয় চ্যালেঞ্জিং। সেটিও অবশেষে জয় করলেন চট্টগ্রামের সন্তান বাবর। আগে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাবর ক্যাম্প-১ ও ক্যাম্প-২ আরোহণ করেছিলেন।
সেখান থেকে বাবর নেমে এসেই জানতে পারেন আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, ভালো আবহাওয়া থাকবে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত। এদিকে রোপ ফিক্সিং টিম আগেই একবার ফিরে এসেছে ৭ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতা থেকে খারাপ অবস্থার জন্য।
এসব তথ্য উল্লেখ করে ফরহান জানান, ওই দলের প্রধান তো ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছিলেন, ক্যাম্প-২ থেকে ক্যাম্প-৩ এ যাবার পথের এত খারাপ অবস্থা তিনি আগে কখনোই দেখেননি। তবুও ২ এপ্রিল ওই দল রওনা করে বাকি পথ তৈরি করতে। এই সম্ভাব্য ভালো আবহাওয়াকে কাজে লাগাতে মাত্র ২৪ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়েই বাবর আবার চড়তে শুরু করেন ৩ এপ্রিল। ওইদিন ক্যাম্প-১ এ থেমে পরদিন উঠে আসেন ক্যাম্প-২।
এর মাঝেই শুরু হয় বিপত্তি। বিকেল থেকেই হঠাৎ শুরু হয় তুষারঝড়। দীর্ঘ যোগাযোগহীনতার পর স্বস্তির সুবাতাস জানান দেয় ৫ এপ্রিল বাবর পেরিয়ে গেছেন কঠিন অংশ, পৌঁছে গেছেন ক্যাম্প-৩ (৬ হাজার ৫০০ মিটার)। সাধারণত ৭ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প-৪ তৈরি করে সামিট পুশ শুরু হলেও সিদ্ধান্ত হয় অবস্থার প্রেক্ষিতে এই ক্যাম্প বাদ দিয়ে ক্যাম্প-৩ থেকেই শুরু হবে চূড়ার উদ্দেশে যাত্রা, অর্থাৎ ওই উচ্চতায় একটানা ১ হাজার ৬০০ মিটার পথ দিতে হবে পাড়ি।
চূড়া পর্যন্ত পথ তৈরি এবং আবহাওয়ার উন্নতির জন্য ক্যাম্প-৩ এ অতিরিক্ত একদিন অপেক্ষা করে ৬ এপ্রিল রাতে ওই চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাবর বেরিয়ে পড়েন। এদিকে রোপ ফিক্সিং টিম সামিট পর্যন্ত পথ তৈরি করতেই ভোরে শীর্ষে উঠে আসেন বাবর আলী। পরবর্তী পরিকল্পনা হলো- সোমবার তিনি নেমে আসবেন ক্যাম্প-২ এ। সেখানে রাতটা কাটিয়ে মঙ্গলবার নেমে আসবেন বেসক্যাম্পের নিরাপত্তায়।
অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান জানান, গত বছর এভারেস্ট-লোৎসে সামিটের পর এবার অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে পৌঁছানোর মাধ্যমে বাবর আলী বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছে। তার কঠোর পরিশ্রম এবং নিরলস অধ্যবসায়ের প্রতিফলন এই সাফল্য। বাবরের অর্জন বাংলাদেশের পর্বতারোহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আমাদের ইচ্ছা ছিল এবার বাবরকে একসঙ্গে তিন পর্বতে পাঠাব।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের একটি পর্বতেই থামতে হয়েছে। আশা করছি এমন সাফল্যের পর বাবরের আগামীর পদযাত্রা পৃষ্ঠপোষকদের কল্যাণে আরেকটু সুগম হবে। কারণ বাবরের লক্ষ্য এই তিনটিতেই থামা নয়, ১৪টি আটহাজারী শৃঙ্গের সবকটিতেই লাল-সবুজের পতাকা উড্ডয়ন।
উল্লেখ্য, এ দুঃসাহসিক অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল ভিজ্যুয়াল নীটওয়্যার্স লিমিটেড, ভিজ্যুয়াল ইকো স্টাইলওয়্যার লিমিটেড, এডিএফ এগ্রো, ফ্লাইট এক্সপার্ট, এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ব্লু জে।
অন্নপূর্ণা ভয়ংকর ও ব্যতিক্রম যেসব কারণে ॥ ফসলের দেবী হিসেবে পূজনীয় সেখানের বাসিন্দাদের কাছে অন্নপূর্ণা পর্বত। এটির অবস্থান নেপালের গন্ডকিতে। এর মূলত চারটি চূড়া আছে। এরমধ্যে শীর্ষ হলো অন্নপূর্ণা-১। পৃথিবীর দশম শীর্ষ পর্বত হলো ৮ হাজার ৯১ মিটারের (২৬ হাজার ৫৪৫ ফুট) উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১। উচ্চতায় দশম হলেও কৌশলগতভাবে অন্যতম কঠিন পর্বত হিসেবে বিবেচিত।
এটি একদিকে আছে শীর্ষে। এর সফল সামিটের বিপরীতে মৃত্যুর হার প্রায় ১৪ ভাগ, যা ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিল ৩২ ভাগ। অর্থাৎ গত মৌসুম পর্যন্ত এই পর্বত সামিট করেছেন ৫১৪ জন এবং মারা গেছেন ৭৩ জন। ১৯৫০ সালের ৩ জুন ফ্রান্সের এক দলের মরিস হেরজগ এবং লুইস লেচেনাল এই পর্বত চূড়া প্রথম স্পর্শ করেন, যা যে কোনো আটহাজারি শৃঙ্গে প্রথম মানব সাফল্য। আর এই বছরই অন্নপূর্ণা-১ প্রথম সামিটের প্ল্যাটিনাম জুবিলি। এই ৭৫ বছরের মধ্যে ২০০৯ সালে অন্নপূর্ণা-৪ এ একবার বাংলাদেশী অভিযান হলেও অন্নপূর্ণা-১ এ এটিই প্রথম অভিযান এবং প্রথমবারেই সফল হন বাবর আলী।
প্রসঙ্গত, বাবর চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। পেশায় চিকিৎসক বাবর আলী ২০২৪ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে একই অভিযানে দুইটি আটহাজারি শৃঙ্গ এভারেস্ট এবং লোৎসে পর্বত এবং ২০২২ সালে অন্যতম টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম শীর্ষে ওঠেন।
অনেক ছয় হাজারি পর্বত বাদেও বাবর প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ভারতের দীর্ঘতম সড়ক কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী করেছেন সাইক্লিং, প্রথম বাঙালি হিসেবে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার একদিক থেকে অন্যদিক। প্লাস্টিক দূষণের বার্তা ছড়াতে তিনি ৬৪ দিনে হেঁটেছেন বাংলাদেশের ৬৪ জেলা। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান বাবর আলী। বাবর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।