
তীব্র খরা আর অনাবৃষ্টিতে পুড়ছে ফটিকছড়িসহ চট্টগ্রাম ভ্যালির ২২ চা-বাগান। দীর্ঘ ৫ মাস বৃষ্টির ছোঁয়া না পেয়ে গাছে বাসা বেঁধেছে পোকামাকড়। প্রতিটি চা-বাগানের ভেতর প্রবাহিত ছোট-বড় ছড়াগুলো শুকিয়ে গেছে। সে কারণে দেখা দিয়েছে পানির তীব্র সংকট।
বছরের শুরুতেই বৃষ্টিপাত শুরু না হওয়ায় এখনও চা-বাগানে বের হয়নি নতুন কুঁড়ি। রোদের তাপে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে চা পাতার উৎপাদন। এতে করে লোকসানের শঙ্কায় পড়েছে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ। নতুন কুঁড়ি না আসায় গত বছরের তুলনায় চলতি বছর চায়ের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। এমতাবস্থায় হতাশায় ভুগছেন চা-বাগান সংশ্লিষ্টরা।
বৃষ্টি না থাকার কারণে চট্টগ্রামের ২২টি চা-বাগান খরায় পুড়ছে। প্রচণ্ড তাপ থেকে বাগান রক্ষা করতে বাগান কর্তৃপক্ষ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। কোনো কোনো বাগানে কলসি দিয়ে সনাতন পদ্ধতির সেচের পাশাপাশি পাইপ দিয়ে কৃত্রিম সেচ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিশাল বাগানের জন্য এই সেচব্যবস্থা খুবই সামান্য।
বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিবছর তারা এ সময় চা-পাতা সংগ্রহ শুরু করে। কিন্তু এ বছর তা সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতির জন্য তারা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে দায়ী করেছেন। চা-শিল্প পুরোপুরি বৃষ্টিনির্ভর। বৃষ্টি না থাকায় তারা বিপাকে পড়েছেন। এখন তারা বিকল্প সেচের মাধ্যমে গাছ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এতে ব্যয় বাড়ছে। তারা সরকারকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছেন।
চা-বাগানের মালিকরা বলছেন, চা-শিল্পের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বৃষ্টি হয়। কোনো বছর ফেব্রুয়ারিতে না হলেও মার্চে বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে মার্চের প্রথম সপ্তাহে অথবা মাঝামাঝি বা শেষ সপ্তাহে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। এতে চা-গাছ সবুজ পাতা মেলতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে পাতা সংগ্রহ করে বাগান কর্তৃপক্ষ উৎপাদনে যায়। কিন্তু এ বছর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ চলে যাচ্ছে। বাগান এলাকায় প্রচণ্ড খরা।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির রামগড়, আঁধার মানিক, নাছেহা, দাঁতমারা, নিউ দাঁতমারা, মা-জান, নেপচুন, পঞ্চবটি, মুহাম্মদনগর, হালদা ভ্যালি, এলাহী নূর, রাঙাপানি, বারমাসিয়া, উদালীয়া, খৈয়াছড়া, আছিয়া, চৌধুরী ও কর্ণফুলী এবং বাঁশখালীর চাঁদপুর বেলগাঁও, রাঙ্গুনিয়ার কোদালিয়া, আগুনীয়া, ঠাণ্ডাছড়ি-সহ মোট ২২টি চা-বাগান রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ফটিকছড়ি উপজেলাতেই আছে ১৮টি।
বারমাসিয়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপক কাজি এরফানুল হক বলেন, চা-বাগানে থাকা বিশাল লেকের মাধ্যমে বর্ষায় পানি সংরক্ষণ করা হয়। সেখান থেকে শুষ্ক মৌসুমে সেচের মাধ্যমে বাগানে পানি দিতে হয়। এবার লেকগুলোও শুকিয়ে গেছে। সাধারণত এই সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু চা-বাগানে এবার বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় বাগানিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ভুজপুর চৌধুরী চা-বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চা-শিল্প শতভাগ বৃষ্টিনির্ভর। বৃষ্টি হলেই চা-পাতা উৎপাদন হয়। কিন্তু এবার বৃষ্টি পাচ্ছি না। ফলে এর প্রভাব উৎপাদনে পড়বে।
রাঙাপানি চা-বাগানের ব্যবস্থাপক উৎপল বড়ুয়া বলেন, প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বৃষ্টিপাত হয়। এখন এপ্রিল চলছে। এখনো বৃষ্টির দেখা পেলাম না। চা-গাছগুলো মরে যাচ্ছে। কলসিতে করে পানি নিয়ে গাছে দিতে হচ্ছে। তাপ থেকে গাছকে রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বাগানে চা-গাছ মরতে শুরু করেছে। বাগানের ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি দেখিনি।
চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালি চা-বাগানের মালিক, শিল্পপতি নাদের খান বলেন, বাগান জ্বলে যাচ্ছে। চা-শিল্পকে রক্ষায় শতভাগ ইরিগেশনের বিকল্প নেই। ইরিগেশন শতভাগ করতে পারলে উৎপাদন দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত হওয়া সম্ভব। অন্যথায় চা-বাগান রক্ষা করা যাবে না। যদিও শতভাগ ইরিগেশন অনেক ব্যয়বহুল। এ জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির বৈরী প্রভাবটা প্রথমেই চা-বাগানের ওপর পড়েছে। কোনো কোনো চা-বাগান বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে বাগানের মালিকদের বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়।
আফরোজা