
ছবিঃ সংগৃহীত
ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ—কিন্তু সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে ঈদ মানে কেবলই বঞ্চনা আর অভাবের তীব্র বাস্তবতা। নতুন পোশাক, সুস্বাদু খাবার আর পরিবারের উষ্ণতা যেখানে ঈদের পরিচিত রূপ, সেখানে এসব শিশু দাঁড়িয়ে থাকে উৎসবের বাইরে, অপূর্ণ স্বপ্ন আর হতাশা নিয়ে।
ঈদের দিনে শিশু-কিশোররা নতুন জামা পরে উল্লাসে মেতে ওঠে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুন্নার জীবনে সেই স্বাভাবিকতার কোনো জায়গা নেই। তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলেটা ঈদের দিনেও লেগুনার পাদানিতে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে চিৎকার করে, "যাত্রাবাড়ি, যাত্রাবাড়ি!"। গায়ের জামা ধুলোয় মলিন, হাতে টাকার দাগ, চোখে অবসাদের স্পষ্ট ছাপ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যাত্রী ডাকতে ডাকতে তাকে সহ্য করতে হয় অসংখ্য তাচ্ছিল্য আর বিরক্তি। কেউ ভাড়া দেয়ার সময় গলা কষে, কেউবা তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলে। তবুও সব অপমান সহ্য করে তাকে দিনশেষে সামান্য কিছু টাকা উপার্জন করতে হয়। সেই টাকাই তার সংসারের একমাত্র ভরসা। ঈদের আনন্দ তার জন্য কেবলই এক অধরা স্বপ্ন।
মুন্নার মতো সোহেলও—এই শহরের অসংখ্য শিশুর একজন, যার ঈদ কাটছে শ্রমের বোঝা বয়ে। বয়স বড়জোর বারো, কিন্তু হোটেলে চায়ের কাপ নিয়ে দৌড়ানোই তার নিত্যদিনের বাস্তবতা। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ছুটে বেড়ায়, চায়ের কাপ নামায়, আবার কিছুক্ষণ পর খালি কাপ তুলতে আসে। ঈদের দিনেও কাজ চলছে অবিরাম; সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানের মালিকের কড়া নজরে বিন্দুমাত্র বিশ্রামের সুযোগ নেই। ঈদের আনন্দের সাথে তার কোনো পরিচয় নেই, বরং সেটা তার প্রতিদিনের কঠিন জীবনের আরেকটি অবিচ্ছেদ্য অংশ মাত্র।
আল-আমিনও সেই তালিকায় পড়ে, যারা ঈদের দিনেও কঠোর পরিশ্রমে ডুবে থাকে। মুদির দোকানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মালামাল গুছানো, ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া, দোকান পরিষ্কার করা—এতেই কেটে যায় তার প্রতিটা দিন। ঈদের দিনে অন্যরা যখন নতুন জামা পরে হাসি-খুশিতে মেতে ওঠে, আল-আমিন তখনও দোকানের কাজ সামলাচ্ছে নিঃশব্দে। তবুও তার মন আশায় ভরে থাকে; সে স্বপ্ন দেখে একদিন তার জীবন বদলাবে, অন্যদের মতো সেও পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারবে।
ডেমরার অটো গ্যারেজগুলোতে কাজ করা অনেক কিশোর শ্রমিদের মাঝে একজন আকাশ। তার সকাল শুরু হয় ভারী যন্ত্রপাতির তীব্র আওয়াজে। টায়ার বদলানো, ইঞ্জিন সারানো, গাড়ির বিভিন্ন অংশ মেরামত করা—এসব কঠিন আর পরিশ্রমসাধ্য কাজেই তার পুরো দিন কেটে যায়। ঈদের দিনেও কোনো পরিবর্তন নেই; ধুলো আর গ্রীসে মাখা হাত নিয়ে কাজ করতে করতে তার দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। তার বন্ধুদের অনেকেই নতুন জামা পরে আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে যায়, সালামি পায়, আনন্দে মেতে ওঠে। কিন্তু আকাশের কাছে ঈদ আনন্দ কেবলই দূর থেকে দেখা একটা দৃশ্য যা ছুঁতে পারে না, অনুভব করতে পারে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রমজীবী শিশুদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে সমাজের সচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। এদের জন্য শিক্ষা ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি সম্ভব। পাশাপাশি, সমাজের সকল স্তরের মানুষ যদি একযোগে এগিয়ে আসে, তবে শ্রমজীবী শিশুদের ঈদও আনন্দ-উৎসবে ভরে উঠবে।
ইমরান