
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ
আর মাত্র দু’দিন পরই পবিত্র ঈদুল ফিতর। কিন্তু ঈদের আনন্দের রেশমাত্র নেই চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার প্রায় ১০ হাজার হাজার জেলে পল্লিতে। তার মধ্যে ৯ হাজার ২২ জন রয়েছে সরকারি নিবন্ধিত জেলে। আর কার্ডধারী জিলে ,কিন্তু বাজেটের আওয়তায় আনা যাযনি এমন সংখ্যা রয়েছে ৮০০ জেলে। তবে প্রকৃতপক্ষে উপজেলায় জেলে সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি রয়েছে। কিন্তু পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে উপজেলার জেলে পরিবারে চলছে হতাশা, নেই কোনো আনন্দ তাদের মাঝে। সর্বত্র ঈদের কেনাকাটা, প্রাণচাঞ্চল্য থাকলেও জেলে পল্লিতে বিপরীত।
জানা যায়, চাঁদপুরের পদ্মা- মেঘনা নদীতে জাটকা রক্ষায় দুই মাস মার্চ-এপ্রিল নদীতে মাছ ধরা বন্ধ। আয়-রোজগার নেই তাদের। সরকার যা দিয়েছে সেই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাই সন্তানদের জন্য নতুন পোশাক কিনতে পারছেন না তারা। এমনকি ঈদের দিন চিনি-সেমাই কেনারও সামর্থ্য নেই অনেকের। কেউ কেউ আশা করছেন, ঈদের আগে দু’একদিন ইলিশ ধরতে পারলে বিক্রি করে খরচটা চালানো যেত। কিন্তু‘ সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঈদ উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক জেলেকে সহযোগিতা করা আপাতত সম্ভব না হলেও কয়েকশ অতি দরিদ্র জেলেকে সরকারের পক্ষ থেকে ঈদ উপহার দেওয়া হয়েছে।
শনিবার চাঁদপুরের মতলব উত্তরের ষাটনল জেলেপাড়া অধ্যুষিত মেঘনা নদীর পাড় ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ধরা বন্ধ থাকায় বেকার সময় পার করছেন অধিকাংশ জেলে। আগামী ১ মে থেকে মাছ ধরা শুরু হবে। তাই অনেকে আবার জাল সেলাই এবং নৌকা মেরামতের কাজে ব্যস্ত। সোমবার অথবা মঙ্গলবার পবিত্র ঈদুল ফিতর। কিন্তু তাদের মাঝে পবিত্র ইদুল ফিতরের কোনো আমেজ বা আনন্দের ছাপ মাত্র দেখা যায়নি।
মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল ইউনিয়নের ষাটনল মাালোপাড়া এলাকার জেলে মোঃ ইলিয়াছ (৪৫) বলেন, গত বছরগুলোতে মাছ ধরেই যে উপার্জন করেছি, তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলেছে। জেলে ইলিয়াছ এর ২ ছেলে ও ২ মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। ঈদে ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীকে নতুন কাপড় দিয়েছি। তবে এবারের ঈদে সমস্যার মধ্যে আছি। ঈদের আর মাত্র দু’দিন বাকী আছে, এখনো জামা-কাপড় কিনতে পারিনি। ঘরে বাচ্চারা কান্নাকাটি করছে। আমরা তো গরিব মানুষ। ৫-১০ হাজার টাকা খরচ করে ঈদের বাজার করার সামর্থ্য নেই। সেমাই-চিনি কিনতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে মাছ ধরতে পারলেই কেবল সেমাই-চিনি, সন্তান ও নিজেদের জন্য কাপড় নিতে পারতাম।
ষাটনল৷ মালোপাড়া এলাকার জেলে নূর মোহাম্মদ খান (৭০) বলেন, আমার বয়স যখন ১০ বছর তখন থেকে আমি নদীতে মাছ সিকার করি, জাল বাওয়া শুরু করি। এহনও পর্যন্ত এই পেশায়ই রইছি। স্ত্রী, ও ৪ সন্তান নিয়ে সংসার। নদীতে মাছ নিকার করে চলে ছেলেদের লেহাপড়া ও সাংসারিক খরচ। এহন নদীতে মাছ ধরা বন্ধ। ‘সরকার দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দিছে, আমরা তা পালন করছি। সরকার যে সহযোগিতা দেয় তা আমি পাই না। আমরা খাইয়া, না খাইয়া খুব কষ্টে দিন কাটাইতাছি। গত এক সপ্তাহের বেশি আমাগো সংসার চলে না। বউ-পোলাপাইন নিয়া খাইয়া-না খাইয়া আছি। আমাগো কোনো কামকাজ নাই। এমন একটা ঈদ আইতাছে, কিন্তু কিছু করার আমাগো পক্ষে সম্ভব না। তিন-চারটা বাচ্চাগো স্কুলে পড়াই, তাদের পড়ালেখাও বন্ধ। বেতন দিতে পারি না। আমরা খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি। সরকার কিছু সাহায্য দিলে উপকার হইতো।’
বৃদ্ধ জেলে মজিবুর রহমান (৫০) বলেন, ‘৫০ বছর ধরে নদীতে জাল বাই। কিন্তু এই বছরের মতো এমন অবস্থা দেখি নাই। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে মেয়ে। ছেলে-মেয়েগো স্কুল বন্ধ, রুজি নাই, পড়ামু কি দিয়া? মাস্টারতো আগে চাইবো বেতন। বেতনের টাকা না দিতে পারলে পিডায়। তাছাড়া কিস্তির টাকা তো দিতেই হয়। সেদিন কিস্তির টাকা দেওয়ার জন্য ঘরের ছয় খান টিন বেইচ্ছা দিছি। এখন ভাত যে খামু হেই টাকাও নাই। তাই ঈদে আমাগো কোনো উপায় নাই। একটা গেঞ্জি কেনার মতো অবস্থা নাই। এমন আরও অনেক জাউল্লা আছে, বেকের (সবার) এই অবস্থা।
উপজেলার এখলাছপুর ইউনিয়নের হাশিমপুর এলাকার জেলে আঃ রহিম বেপারী বলেন, সোহেল বলেন, ‘আমরা নদীর ওপর নির্ভরশীল । পোলাপাইনের লেখাপড়ার খরচ, সংসার খরচ দিয়াই আমরা কুলাইতে পারি না। ‘ঈদ আইয়া পড়ছে। কিন্তু এখনো বাচ্ছাদের জামা-কাপড় দিতে পারি না। নদীতে নামতে পারলে হয়তো কিছু দিতে পারতাম। এবারের ঈদে নিজেও কিছু নিতে পারমু না, তাগও কিছু দিতে পারমু না। চলতেই তো কষ্ট হইতাছে। আমাদের কাছে টেকা-পইসা নাই, চিনি-সেমাই এগুলো মনে হয় এবার আমাগ কপালে জুটব না।’
মতলব উত্তর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, চাঁদপুরের মতলব উত্তরসহ চাঁদপুরে ৪৪ হাজার ৩৫ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। এরমধ্যে মতলব উত্তর উপজেলায় রয়েছে ৯ হাজার ২২ জন নিবন্ধিত জেলে। আর কার্ডধারী রয়েছে ৮০০ জেলে। এটা বড় সংখ্যক কমিউনিটি। এখানে তো এক-দুইশ লোক না। তবে সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধকমূলক উপকরণ হিসেবে সেলাই মেশিন, ছাগল, গরু ও পরিবেশবান্ধব জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হয়েছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এগুলো করা হচ্ছে। ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধনকৃত প্রত্যেক জেলেকে প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চার মাসে ১৬০ কেজি চাল দেওয়া হয়। চালের অর্ধেক ইতোমধ্যে জেলেদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, বর্তমান সরকার জেলেদের চাল, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করছে। ঈদকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে জেলেদের সরকারের পক্ষ থেকে ঈদ উপহার দেওয়া হয়েছে। সবাইকে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে যারা খুব দরিদ্র তাদের ঈদ উপহার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিবন্ধিত সব জেলেকে ঈদের আগেই সরকারি চাল সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সহায়তা বাড়ানোর বিষয়টি সরকারিভাবে চিন্তাা করতে হবে।
উল্লেখ্য, জাটকা রক্ষা ও ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার, চাঁদপুর সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর থেকে শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার তারাবুনিয়া থেকে নড়িয়া উপজেলার ভোমকারা পর্যন্ত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটারসহ মোট পাঁচটি অভয়াশ্রম অঞ্চলের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার নদী অঞ্চলে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস অভয়াশ্রম ঘোষণা করে সব ধরনের জাল ফেলা ও মাছ ধরা নিষিদ্ধের কার্যক্রম চলছে। এ সময় অভয়াশ্রম অঞ্চলে লাখ লাখ জেলে পরিবার বেকার হয়ে পড়ে। সরকার অভয়াশ্রমে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে পরিবারকে নিবন্ধিত করে ফেব্রুয়ারি থেকে মে—চার মাস প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে ভিজিএফ চালসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে থাকে।
শিহাব